শ্রাবণ মেঘের দিন: সামাজিক ছায়াচিত্রের আড়ালে মুক্তিযুদ্ধ । ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

১৯ জুলাই নন্দিত কথাশিল্পী নাট্যকার চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদের প্রয়াণদিবস।

0

[১৯ জুলাই নন্দিত কথাশিল্পী নাট্যকার চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদের প্রয়াণদিবস। এ উপলক্ষে তাঁর কিছু কালজয়ী চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এ পর্বে থাকছে শ্রাবণ মেঘের দিন নিয়ে আলোচনা।]

সত্যিকারের শিল্প হয়ে উঠতে গেলে চলচ্চিত্রে দুটো মূল জিনিস থাকা চাই। প্রথমত শিল্পের নূতন মাধ্যম হিসেবে তার যে নিজস্ব ধর্ম আছে  শিল্পের(art) দিক থেকে সেগুলো ভালোভাবে ফোটা দরকার। এই শিল্প হলো নৃত্যকলা সঙ্গীত চিত্রনাট্য ও সাহিত্য।  দ্বিতীয়ত  এই শিল্পগুলোর প্রত্যেকটিসৃষ্টির মধ্যে রুচিবোধ, মাত্রাজ্ঞান, সরলতাএগুলোর সুষম সমম্বয় থাকা প্রয়োজন। যদি এই দুইয়ের সমম্বয় ঘটে তবেই তা কষ্টিপাথরে যাচাই হয়েকালজয়ী চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়।  আমরা যাকে সচরাচর বলি  সিনেমা হিট হয়েছে বা  উতরে গিয়ে সুপার ডুপার হয়েছে। সত্যজিত রায়ের পঞ্চাশের দশকের চলচ্চিত্রে সেরূপ আমরা দেখতে পাই। কালোত্তীর্ণ সেসকল চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অপরাজিত [১৯৫৭] সাড়ে চুয়াত্তর [১৯৫৩] অপুর সংসার [১৯৫৯] ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে যখন দর্শক খরা চলছে সেই মুহুর্তে খ্যাতিমান কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন। আগুনের পরশমণির পর নির্মাণ করেন সামাজিক ঘটনার আড়ালেমুক্তিযুদ্ধ নিয়েগ্রামীণ পটভূমিকায় অত্যন্ত হ্নদয়স্পর্শী ছবি শ্রাবণ মেঘের দিন। বাঙালি দর্শক ফিরে গেলেন প্রেক্ষাগৃহে। সত্যজিত রায়ের পর আবারো চলচ্চিত্রকে শিল্পের মূলধারায় নিয়ে এলেন  হুমায়ূন আহমেদ। সিনেমার যে আধুনিক ধারা লক্ষ্য করা যায় চিত্র পরিচালক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের ছবিগুলোতে  তার লক্ষণগুলোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ব্রেসন এর মতে ব্যাপক অর্থে ফিল্মকে গীতাত্মক হতে হবে – যেন ছন্দে বিধৃত কতিপয় দৃশ্যের সুবিন্যস্ত পারম্পয থাকে। তিনি ফিল্ম তৈরির এই নতুনরীতির নাম দিয়েছেন ল অফ দি টেকনিক অফ পোয়েট্রি। ব্রেসন বিশ্বাস করতেন যে এই রীতির সমাদর আজ না হতে পারে কিন্তু আগামী পঞ্চাশ কি একশো বছরের মধ্যে এই রীতিই হবে সর্বজন গ্রাহ্য। চিত্র পরিচালক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ এই রীতিকে অনুসরণ করেন। শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে আমরা সেই রূপটিই দেখতে পাই। ছায়াছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মতি [জাহিদ হাসান] একজন গায়ক। তার বিপরীত চরিত্রের চিত্রণে আমরা দেখতে পাই কুসুম [শাওন]কে। সেও একজন গায়িকা। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য গায়ক মতি মিয়াকে বিয়ে করে একটি গানের দল তৈরি করে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে। আবার কুসুমের  বাবা উজান থেকে একটি ছেলে সুরুজ [মাহফুজ] কে নিয়ে আসে কুসুমের সথে বিয়ে দেয়ার জন্য। সেও একজন গায়ক। চিত্রনাট্যের প্রবেশ হয়েছে সঙ্গীতের মাধ্যমে। আকস্মিকভাবেগায়ক মতি মিয়ার[জাহিদ হাসান] সাথে জমিদার নাতনী শাহানার [মুক্তি] সাক্ষাৎ নৌকাতে। যেখানে গায়ক মতি মিয়া নৌকা ভাড়ার বিনিময়ে গান শুনিয়ে আকৃষ্ট করেন আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত শহুরে জমিদার নাতনীদের। প্রথমটায় তারা হতভম্ব হন। যাত্রাপথে বই পড়ার ডিস্টার্ব হবে বলে গায়ক [নৌকার মাঝির ভাষায় বিরাট গাতক] মতিকে ছোট নাতনী সাবধান করেন। কিন্তু পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ মতি মিয়ার গলায় মিলিয়ে দেন বাউল সাধক উকিল মুন্সীর লেখা গান-

পুবালী বাতাসে

বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি

আমার নি কেউ আসে রে।।

কি অদ্ভূত শুনশান নীরবতা! নৌকার সহযাত্রী জমিদার নাতনীদের সাথে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহের দর্শকের হ্নদয়েও একাত্ম হয় দেহতত্ত্বের গান।   এটি এই চলচ্চিত্রের একটি চমক! গানের দৃশ্যায়নে চলচ্চিত্রে প্রবেশ আবার শেষ দৃশ্যও আরেক দেহতত্ত্ব গানের মাধ্যমে বিদায়। বিষপানরত কুসুম [শাওন]কে নিষ্ফল বাঁচানোর চেষ্টায় প্রাণপন দুইজন মতি মিয়া [জাহিদ হাসান] এবং সুরুজ [মাহফুজ] নৌকায় যাত্রা করে ডাক্তার শাহানা [মুক্তি]র চিকিৎসার আশায়। কিন্তু সময় মৃত্যুর সাথী হয়ে যাত্রা করে।হাতের মেহেদীর সাথে পায়ে আলতার আলপনাকে চুম্বন করে মৃত্যুসুধা। হতবিহ্বল মতি কুসুমের [শাওন] মুখ পানে চেয়ে বুকফাটা আর্তনাদ করে। কিন্তু সে আর্তনাদ কান্নায় নয় সঙ্গীতে। উকিল মুন্সীর বাউলিয়ানা সঙ্গীতে হ্নদয় তোলপাড় করে । হাওরের পানি আর সুনীল আকাশের দৃশ্যায়ন  দর্শককে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের  বাউলের সহজিয়াদর্শনের পথে। মরমী সাধক  উকিল মুন্সীর কথায় সঙ্গীত শিল্পী বারী সিদ্দিকীর কন্ঠে তুলে আনেন চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ এভাবে-

শুয়াচানপাখিআমারশূয়াচানপাখি
আমিডাকিতাছিতুমিঘুমাইছনাকি।।

তুমিআমিজনমভরা
ছিলামমাখামাখি,
আজকেনহইলেনীরব
মেলোদুটিআঁখি।।

কিন্তু মতিমিয়ার [ জাহিদ হাসান] গগন বিদারী বুকফাটা আর্তনাদের ডাক কুসুম [শাওন] আর শুনতে পায় না।  তখন তিনি পাড়ি জমিয়েছেন হাওড়ের পানি ছেড়ে পারলৌকিক জীবনের পথে।হতবিহ্বল দর্শক খানিকটা হলেও বিচ্ছেদের সুর শুনতে পায় চেনা জানা জগতে। যেখানেশুধুই একটা দীর্ঘশ্বাসের প্রতিবিম্ব আছড়ে পড়ে।কেউবা আড়ালে চোখও মুছে। এখানেই চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের বড় কৃতিত্ব।

হুমায়ূন আহমেদের কল্পনাশক্তি আর আশ্চয তাঁর দৃশসংস্থান জ্ঞান। সঙ্গীতকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে নয়টি গান ব্যবহ্নত হলেও তা সমানভাবে জনপ্রিয় পেয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ গীতিকার হিসেবে এ ছবির মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটান। মকসুদ জামিল মিন্টু সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব সুচারু রূপে পালন করেন যার প্রমাণ স্বরূপ এই ছবির সঙ্গীতের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। চিত্র নাট্যে ব্যবহ্নত সবগুলো সঙ্গীতের অসামান্য অবদান রয়েছে। সঙ্গীতেরও যে প্রাণ আছে দর্শন আছে চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ দৃশ্যায়নের মাধ্যমে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।

হুমায়ূন আহমেদের ছবিগুলোতে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে মিশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে নিজের পরিবারের প্রধানকে হারানোর ব্যাথা তাঁর স্মৃতিতে জমা আছে ।  তাইতো পুঞ্জীভূত জীবনের ঘটনা থেকে  ক্রোধ বা  ঘৃণা জমা হয়েছে  মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকারদের প্রতি। এ যেন গভীর ঘৃণা থেকে উঠে আসা স্পর্ধিত  সাহস। তাইতো আমরা দেখি যখন কেউ রাজাকার বলতে ভয় পেত, মুখ খুলে সত্য ঘটনা প্রকাশে অনীহায় লিপ্ত, তখন তিনি নাটক গল্প সিনেমায় রাজাকার প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতেও রাজাকার চরিত্রের দেখা মেলে। গ্রামের জমিদার [গোলাম মোস্তফা] মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সমর্থক এবং রাজাকার ছিলেন। তার বাড়িতে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। এ কারণে তিনি নিজপুত্রসহ গ্রামবাসী সবার কাছে ঘৃণিত এক ব্যক্তি।

আমাদের গৌরবের ইতিহাস মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। কিন্তু সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীরা আজো দেশ ও জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। হুমায়ূন আহমেদ জনসম্মুখে তুলে এনেছেন শ্রাবণ মেঘের দিনের জমিদারের ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে। এর শ্লেষ যেমন মর্মান্তিক করুণার খাতটিও তেমন অতলস্পর্শী। নাতনীর [মুক্তি]  যুক্তি এবং সত্যের কাছে পরাজিত হয়ে শেষ পযন্ত জমিদার [গোলাম মোস্তফা] গ্রামবাসীর কাছে হাত জোড় করে বলছেন:

“মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছিলাম। সেই অন্যায়ের জন্য মহান আল্লাহ পাকের কাছে দেশের মানুষের কাছে  আপনাদের সকলের কাছে ক্ষমা চাই। হাত জোড় করে ক্ষমা চাই। হাত জোড় করে ক্ষমা চাই। হাত জোড় করে ক্ষমা চাই।”

শ্রাবণ মেঘের দিন হুমায়ূন আহমেদের নিজের লেখা উপন্যাস। এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে সময় প্রকাশন থেকে। পাঠক জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ এটির চিত্রনাট্যরূপ দেন এবং২০০০ সালে উপন্যাসের নামকরণেইচলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।নবীন প্রবীণ সকল শিল্পী সুন্দর অভিনয় করেছেন। শ্রাবণ মেঘের দিন দেখলে প্রত্যেকেরই শিল্পী সত্ত্বার প্রতিভার প্রকৃত নিদর্শন পাওয়া যায় ।  অভিনয়, চিত্রগ্রহণ পরিচালনা সব দিক থেকেই প্রথম শ্রেণীর। এ কারণেই বাংলাদেশের ২৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে সাতটি শাখায় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়। এ ধরণের ছবি দেখলে চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশা জাগে।

শ্রাবণ মেঘের দিন সম্পর্কে দর্শকদের প্রশংসা ছিল প্রত্যাশার চাইতে অনেক বেশী।২০১৯ সালে এসেও এর আবেগ দর্শকদের মাঝে আরো বেশী। সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রাবন মেঘের দিন চলচ্চিত্র দেখে জনৈক দর্শক মন্তব্য করেছেন :

“কি বলব !এত সুন্দর!! অপূর্ব!! বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তবে এটা বলবো কুসুম এর মৃত্যুতেই কান্না থামলোনা আমার। ভালোবাসা ভালো থাকুক সবার মাঝে। এখনো আমাদের গ্রাম বাংলা আর আমাদের বাংলাদেশের মানুষের যে অপূর্ব একটা মন আছে এটা তুলে ধরা হয়েছে। ভালোবাসি আমার বাংলাকে আমার বাংলাদেশের মানুষকে। ২০১৯ সালে এই ছবিটা দেখছি বলে নিজেকেই ছোট মনে হচ্ছে। তবে এখন খুব প্রাউড ফিল করি আমি হুমায়ূন স্যার এর একজন ভক্ত বলে । … স্যার আপনাকে খুব ভালোবাসি।“

এত সুন্দর চিত্র নির্মাণ কিভাবে সম্ভব? হয়ত তার প্রত্যুত্তরে বলা যায় বাঙালির সমাজ জীবনের হিউমার বা সামাজিক জীবনের রসাত্মক বোধ হুমায়ূন আহমেদের করায়ত্ত্ব ছিল । সামাজিক জীবনের রসবোধ, নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্তের দুস্তর ব্যবধান, দৈনন্দিন জীবনের সাথে  ফ্লাশব্যাকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে এনেছেন আখ্যান হিসেবে। ফলে তাঁর স্টাইলকে বিশেষত্ব দিয়েছে। শ্রাবণ মেঘের দিন মূলত সামাজিক আখ্যান হলেও হুমায়ূন আহমেদের চিত্র নাট্য লেখা এবং পরিচালনার গুণে মেলোড্রামার বহু উর্ধ্বে উঠে গেছে। তিনি হয়ে গেলেন আমাদের যুগের অন্যতম একজন ফিল্ম স্রষ্টা।

ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর- পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।

 

 

 

 

 

 

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.