মায়াজালে এখনো আমি । আনান্নিয়া আন্নি
পর্বঃ ১৭
নীড় যে হিন্দু এই কথাটি শুনে আমি যতটা না অবাক হয়েছি তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছি আমি এইজন্য যে এই কথাটি আমার ইমাদ এর মুখ থেকে শুনতে হয়েছে, এতো বড় একটা সত্যি কিনা আমাকে জানতে হয়েছে অন্য কারো মাধ্যমে? এরকম একটা দিন যে আমার জীবনেও আসবে এটা কখনও কল্পনাও করতে পারিনি আমি।
আমি শুধু নীড় এর চোখে চোখ রেখে একবার ওকে জিগ্যেস করেছিলাম এ কথাটি সত্যি কিনা? নীড় এর চোখ দুটোই বলে দিচ্ছিলো এটা সত্য কিন্তু এ সত্যের কারন কি সেটা আমি আর জানতে চাইনি ওর কাছে।
ইমাদ এর হাত থেকে হাত টা সরিয়ে চলে এসেছি ওখান থেকে, পেছন থেকে নীড় ডাকছিলো বারবার..
অপ্সরা শোনো আমার কথাটা একবার শোনো অপ্সরা.. কিন্তু আমি আর পিছু ফিরে চাইনি। আজ আবারও মনে হচ্ছে কেউ আমাকে অসম্মান করলো; নিস্তব্ধ একটা মিথ্যে কথার বেড়াজালে মুড়িয়ে কেউ আমার সুন্দর বিশ্বাস নামক অনুভূতি কে অপমান করলো…
(২৮ নভেম্বর)
তারপর থেকে ফোন টা বন্ধ রেখেছি, কারণ বড্ড বেশি ফোন কল আসছিলো, সেই ফোন কলের আওয়াজ যেনো মনে হচ্ছিল কোনো দোষী মানুষের আবারও একগাদা মিথ্যে বলে নির্দোষ সাজবার আকুতি।
সকালবেলা ফোন টা অন করতেই আবারও সেই ফোন কল!
একবার দুবার বেশ কয়েকবার ফোন টা বেজেই চলেছে,, বাধ্য হয়ে রিসিভ করলাম।
অপ্সরা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে,প্লিজ তুমি আমার কথাগুলো একবার শোনো।
যা শোনার দরকার ছিলোনা তা এতোদিন শুনে এসেছি নীড়, আর যেটা শোনার দরকার ছিলো সেটা তুমি আমার থেকে বেমালুম লুকিয়ে গিয়েছো। এখন আর আমার তোমার কাছে কিছু শোনার নেই।আমি ফোন টা কাটতে গিয়েও যেনো নীড় এর কথাগুলো শুনবার ইচ্ছেই আর কাটতে পারলামনা, ও বলতে শুরু করলো;
যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছিলাম, আমার তোমার জন্য ভেতরে একটা ভালো লাগা কাজ করেছিলো,তারপর তোমার সাথে মহুয়া-র স্কুলে দেখা, তোমার নাম্বার যোগাড় করে তোমার সাথে যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা।
আমি তোমার কাছে কিছু লুকোতে চাইনি অপ্সরা,আমার কাছে তুমি মানে শুধুই তুমি, তুমি হিন্দু কি মুসলিম সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি জানতাম তুমি মুসলিম ঘরের মেয়ে কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই তোমার থেকে এগুলো আড়াল করে গিয়েছি। আমি নাহয় তোমাকে ভালো রাখতে নিয়ম ভঙ্গ করলাম, আমি নাহয় তোমায় ভালো রাখতে চলে গেলাম সমাজের বাইরে, তাতে কিচ্ছু হবেনা অপ্সরা, বরং তুমি ভালো থাকবে, আমি ভালো থাকবো, আমরা ভালো থাকবো।
চুপ করো নীড়,, এসব নীতিবাক্যের বেড়াজালে নিজের দোষ আড়াল করার চেষ্টা করতে হবেনা তোমার, তাতে আর কোনো লাভ হবেনা। তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছো আমার সাথে। ব্যাস এতটুকু বলেই ফোন টা আবারও কেটে বন্ধ করে রাখলাম।
সবকিছু কেমন এক নিমিষেই এলোমেলো হয়ে গেলো, এমন টা তো না হলেও পারতো, কি ক্ষতি হতো যেমন চলছিলো তেমন চললে?
(২২ ডিসেম্বর)
আজ সকালে দুচোখ মেলে যেনো বুকের ভেতর কেমন হাহাকার হয়ে যাচ্ছিলো আমার, একজন মানুষের থেকে মুক্তি নিয়ে যখন সবে সবে কারো সাথে আমি একটু ভালো থাকবার প্রচেষ্টা শুরু করেছি ঠিক তখনই কেনো আবার সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো? আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে দৌড়ে চলে যাই নীড় এর কাছে, ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলি তুমি ছাড়া আমাকে ভালো রাখার মতোন কেউ নেই নীড় কেনো করলে আমার সাথে এমন?
দুপুর দু’টো, বড় ভাইয়া মেজো ভাইয়া আর কুমু টেবিলে খাচ্ছে,আমি দাড়িয়ে শশা কাটছি, বড় ভাবি খাবার তুলে দিচ্ছে। কালকের ঘটনা টা কেউ জানেনা, এমনকি ভাবিকেও কিছু বলিনি। তবে ভাবি হয়তো আন্দাজ করেছে কিছু একটা হয়েছে তবে কি হয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি বোধহয়।
দরজায় বেল বাজতেই ভাবি গিয়ে দরজা খুলে দিলো; কে আসতে পারে এখন? ছোট ভাইয়া আর মেজো ভাবি অফিসে, ওদের তো এই অসময়ে আসার কথা নয়, তাহলে কি নীড় এলো? আমি ধরেই নিয়েছিলাম দরজার ওপাশে নীড় দাঁড়িয়ে আছে, বোধহয় আজ সে আমার বাড়িতে এসে বলবে, সব বাধা ধরা নিয়মের উর্ধ্বে গিয়ে হলেও আমি অপ্সরা কে বিয়ে করতে চাই।
কিন্তু না,,, আমার ভাবনাচিন্তা সম্পুর্ন টাই ভুল ছিল, দরজায় যে এসেছিলো সে নীড় নয়, সে ছিলো ইমাদ!
দরজা খুলে আমার দিকে তাকানো ভাবির সেই অদ্ভুত দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কিছু গড়বড় হয়েছে, তা বলে এতো বড় একটা গড়বড় হবে আমি সেটা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি কখনও।
ইমাদ এসেছে, বাড়ির সবাই ওকে চেনে তাই আর আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়নি কিন্তু ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার পরও আবার ওর এখানে আসা নিয়ে অনেক কারন বর্তাতে হয়েছে আমাকে।
ইমাদ কে বসতে দিয়ে বড় ভাবি আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে আবার, ইমাদ এর এ বাড়িতে আসার কারন কি? আমি বললাম অনেক কিছুই হয়েছে ভাবি, তুমি আগে ওর থেকে শোনো ও কেনো এসেছে তারপর আমি সবটা বলবো তোমায়।
বড় ভাইয়া মেজো ভাইয়া আর বড় ভাবি গিয়ে ইমাদ এর সাথে কথা বলতে শুরু করলো। ওর এখানে আসার কারন জানতে চাইলে ও বললো;
আমি অপ্সরার বিয়ের প্রস্তাব জানাতে এসেছি,আগামি সাতদিনের ভেতর আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
বড় ভাবি বললো;
বিয়ে করতে চাও মানে? তাও আবার সাতদিনের ভেতর? আমি তো জানি তোমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই অন্তত বিয়ে হওয়ার মতোন সুন্দর সম্পর্ক তো অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে বলেই আমি জানি, দুম করে তোমার এ বাড়িতে এসে এমন একটা সিদ্ধান্ত জানানোর কোনো কারন আমি দেখতে পাচ্ছি না ইমাদ। এটা কোনো ছেলেখেলা নয়, তাই ভেবেচিন্তে কথা বলাই উচিৎ।
আমি ভেবেচিন্তেই কথা বলছি,আপনাদের বাড়ির মেয়ের সাথে আমি সব সম্পর্ক চুকিয়েই দিয়েছিলাম কিন্তু সে এখানেই থেমে থাকেনি, নতুন করে একজন হিন্দু ছেলে-র সাথে আবারও প্রেমের সম্পর্ক করেছে, আপনারা চাইলে জিগ্যেস করতে পারেন, আমার মনে আর ওর জন্য এক বিন্দু ভালোবাসা ও নেই কিন্তু আমি চাই ওকে বিয়ে করে সারাজীবন অশান্তির আগুনে ওকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে, ওর এই নষ্টামির পরিসমাপ্তি ঘটাতে চাই আমি।
ইমাদ এর এমন ধারা কথাবার্তা শুনে বড় ভাইয়া মেজো ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে পরেছে, আমার সম্পর্কে ইমাদ এর মুখে এমন খারাপ ভাষা শুনে সবাই অবাক হয়েছে আর খুব কষ্ট ও পেয়েছে। আমি ড্রয়িং রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছি;
বড় ভাইয়া বলছে..
ঠিক করে কথা বলো ইমাদ, আমার বাড়িতে দাড়িয়ে আমারই বোনের সম্পর্কে এভাবে কথা বলার দুঃসাহস তুমি পাও কোত্থেকে?
ইমাদ উঠে দাঁড়িয়ে পরেছে, শেষবার সেই একই কথা বলে সে হনহন করে বেরিয়ে গেলো,আগামী সাতদিনের মধ্যে আমি অপ্সরা কে বিয়ে করতে চাই, আর যদি এর বিপরীত হয় তবে আমি ঠিক সেই কাজগুলো করবো যে কাজ গুলো করলে আপনার বোন এবং আপনারা সমাজের কাছে মুখ দেখাতে না পারেন….
ইমাদ চলে গেলো, আমি যেনো ওর কথাগুলো শুনে হতভম্বতা কাটাতে পারছিনা, কি বলে গেলো ও এসব? আমার সাথে কেনো করছে এমন?
আমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে বড় ভাইয়ার সামনে দাঁড়াতেই বড় ভাইয়া সপাটে এক চড় বসিয়ে দিলো আমার গালে…
চলবে….❤️