ই-কমার্স প্রতারণা রোধে কঠোর পদক্ষেপ

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : অনলাইন প্ল্যাটফরমে পণ্য বা সেবা বিক্রির নামে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর নানামুখী প্রতারণা রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকের সঙ্গে ধোঁকাবাজি, হয়রানি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার রোধে একযোগে কাজ করছে সরকারের কমপক্ষে নয়টি দফতর। সেগুলো হচ্ছে- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এরা ই-কমার্স কোম্পানির পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের নামে প্রতারণার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে। সংস্থাগুলো বিভিন্ন অভিযান ও তদন্তে প্রাপ্ত অপরাধের তথ্য নিজ নিজ আইনের আওতায় না পড়লে অন্য সংস্থাকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ পাঠাচ্ছে।

পরস্পর সমন্বয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন সবগুলো প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করায় অনলাইন প্ল্যাটফরমে পণ্য বিক্রির নামে গ্রাহক প্রতারণা রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে পাওয়া যেসব অভিযোগ আমাদের তফশিলভুক্ত হয়, সেগুলো আমলে নিয়ে পৃথক কমিটি করে বা স্বতন্ত্রভাবে কর্মকর্তা নিয়োগ করে অনুসন্ধান করছি। অনুসন্ধান কর্মকর্তারা তাদের প্রয়োজন অনুসারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। ইভ্যালিসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান ও তদন্ত অব্যাহত আছে। কিছু কোম্পানির বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ এখনো কমিশনের কার্য তালিকায় আসেনি।’ সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের প্রধান ও ডিআইজি মোহাম্মদ আবদুল্লাহেল বাকী বলেন, ‘ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, আলাদীনের প্রদীপ, কিউকম, বুমবুমসহ অনলাইন ফ্ল্যাটফরমে পণ্য বা সেবা বিক্রয় করা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা, অর্থআত্মসাৎ ও অর্থ পাচার নিয়ে আমরা তদন্ত অব্যাহত রেখেছি। আর কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে কঠোরভাবে তদন্ত করে দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

এক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য দফতরের সঙ্গে সমন্বয় করেই আমরা কাজ করছি।’ ডিবি পুলিশের প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাজিফ আক্তার বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতারণার শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত ভুক্তভোগী মানুষ আমাদের কাছে অভিযোগ জানান। আমরা সেগুলো আমলে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করছি এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। অর্থ পাচারসহ কিছু তফসিলভুক্ত অপরাধ আমরা সিআইডি এবং দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ‘আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করেই কাজ করি। গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে এ বিষয়ে আমরা গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে পারি না।’ নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর মূল্যসংযোজন কর ঢাকার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘অনলাইন কেনাকাটায় ভ্যাটফাঁকিসহ নানা আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে আমরা ভ্যাট আইনে বেশ কিছু মামলা করেছি। ই-অরেঞ্জ, আলেশা মার্ট, পেপারফ্লাই, ইভ্যালিসহ অনলাইন প্ল্যাটফরমে পণ্য বিক্রয়কারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করা হয়েছে। আরও যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান শুল্ক ও মূল্যসংযোজন কর ফাঁকি দিয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রেখেছি। এসব প্রতিষ্ঠানে অভিযানের সময় দেখা যায় অর্থ পাচারসহ কিছু অপরাধ এমন আছে যা আমাদের আইনের আওতায় পড়ে না, এসব অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দফতরে তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি। পাশাপাশি তারাও আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।’ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সঠিকভাবে ভ্যাট আদায় করা গেলে গ্রাহক প্রতারণা অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ নানামুখী জালিয়াতি রোধে সরকারের বেশ কয়েকটি দফতর কাজ করছে। এদের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। প্রয়োজনে এ সংক্রান্ত কমিটি করার পরিকল্পনাও রয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে কিছু দাফতরিক পদক্ষেপ আটকে আছে।

তিনি দেশে ফেরার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সমন্বয়ে কমিটি করার পরিকল্পনাও রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।’ জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৯টি ই-কমার্স কোম্পানির তথ্য চেয়ে বিএফআইইউকে চিঠি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ধামাকা, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদীনের প্রদীপ, কিউকম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, আলেশা মার্ট ও নিডডটকমডটবিডি। চিঠিতে ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছে কোম্পানিগুলোর মোট দায়ের পরিমাণ এবং কোম্পানিগুলোর চলতি ও স্থায়ী মূলধনের পরিমাণ, কোম্পানিগুলো মানি লন্ডারিং করেছে কিনা এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম মূল্য সংগ্রহ করে পণ্য সরবরাহ না করা এবং মার্চেন্টদের কাছ থেকে পণ্য কেনার পরও বকেয়া পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে। কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে সিআইডি। ইভ্যালিসহ ১৪টি কোম্পানির বিরুদ্ধে অবৈধ এমএলএম কর্মকান্ড পরিচালনা এবং ধামাকা, ই-অরেঞ্জসহ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। ইতিমধ্যে গ্রাহকদের করা মামলায় ই-অরেঞ্জের দুজন মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধামাকার মালিকপক্ষের কয়েকজন বিদেশে পলাতক রয়েছেন। ইভ্যালির বিরুদ্ধে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।

ইতিমধ্যে কমিশন গ্রাহকের দায়-দেনাসহ ব্যবসার যাবতীয় নথিপত্র চেয়েছে। ইভ্যালির এমডি এবং সিইও মো. রাসেলের কাছে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর রয়েছে ইভ্যালির অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান টিমের প্রধান দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর। ইভ্যালি ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক, সিটি করপোরেশন ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) অনুমোদন-সংক্রান্ত নথিসহ কিছু নথি সরবরাহ করেছে বলে জানা গেছে। দুদক ইভ্যালির কাছে যেসব তথ্য চেয়েছে তা হলো সব ধরনের লাইসেন্স; ব্যবসায়িক মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য, কী পরিমাণ ক্রয় আদেশের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করা হয়নি, ওই সব আদেশের বিপরীতে টাকার পরিমাণ কত, ক্রেতার আদেশের বিপরীতে বকেয়া কীভাবে হলো, কোন পদ্ধতিতে হলো; গ্রাহকের দায় শোধ করতে ইভ্যালির পরিকল্পনা কী, বিদ্যমান ব্যবসায়িক সংকট মোকাবিলায় তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং ব্যাংকের ঋণসহ সব রকম দায়-দেনার হিসাব।

ইভ্যালির কাছে দুদক আরও জানতে চেয়েছে তাদের (ইভ্যালি) বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত শুরুর পরে কত সংখ্যক গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করেছে, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এযাবৎ কত টাকা ভ্যাট, ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন অর্থ বছরে কোম্পানির অডিট প্রতিবেদন, কোম্পানির সার্বিক খরচের হিসাব, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যয় করা অর্থের উৎস, সময়ে সময়ে বিভিন্ন পণ্যের অফারে এ পর্যন্ত গ্রাহকদের ছাড় দেওয়া অর্থের মোট পরিমাণ, এযাবৎ যত টাকার অফার দেওয়া হয়েছে তার মোট মূল্যের হিসাব। দুদক কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে ইভ্যালির এমডি ও চেয়ারম্যানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে শিগগিরই কমিশনে তলব করা হবে। এদিকে ভ্যাট গোয়েন্দা জানিয়েছে, অর্থ পাচারের পাশাপাশি ই-অরেঞ্জ বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। গতকালও তাদের বিরুদ্ধে ১৩ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত ই-অরেঞ্জ কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে ১৩ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য মিলে।

ইভ্যালির কাছে গ্রাহকের পাওনা ৩০০ কোটি টাকা : ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির কাছে গ্রাহকদের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট গ্রাহকের সংখ্যা ২ লাখ ৭ হাজার ৭৪১ জন। গতকাল ইভ্যালির পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রতিষ্ঠানটিকে ৩ সপ্তাহে তিন ধরনের তথ্য দেওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে গত সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটি যেসব কোম্পানি থেকে পণ্য কিনে থাকে তার হিসাব দিয়েছিল। ওই হিসাবে ইভ্যালি জানিয়েছিল তাদের কাছে মার্চেন্ট কোম্পানিগুলোর পাওনা ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইভ্যালি যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ও মার্চেন্ট কোম্পানি মিলিয়ে মোট দায়ের পরিমাণ প্রায় ৮৪৩ কোটি টাকা। অথচ প্রতিষ্ঠানটির মূলধন মাত্র ১ কোটি টাকা।

কর্মকর্তারা জানান, ইভ্যালিকে তৃতীয় দফায় ‘মার্চেন্টদের কাছে দেনার পরিমাণ, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের দায় পরিশোধের সময়বদ্ধ পরিকল্পনা’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জানাতে হবে আগামী ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। ওই পরিকল্পনা দেখে বলা যাবে প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে এসব দায়দেনা পরিশোধ করবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে গতকাল ইভ্যালি জানিয়েছে, একজন গ্রাহক এক বা একাধিক ক্রয়াদেশ (অর্ডার) দিয়ে থাকেন। গ্রাহকদের অধিকাংশই ইভ্যালির মোট কার্যকাল দুই বছর ছয় মাসে বিভিন্ন ক্রয়াদেশ দিয়েছেন এবং সফলভাবে পণ্য সরবরাহও পেয়েছেন।

এ পর্যন্ত ৭০ লাখের বেশি ক্রয়াদেশের পণ্য সফলতার সঙ্গে সরবরাহ হয়েছে এবং ভোক্তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক বজায় আছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করে ইভ্যালি। তবে কিছু সংখ্যক গ্রাহক পণ্য না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়ছে, পর্যাপ্ত সময় ও অনুকূল পরিবেশ পেলে ছয় মাসের মধ্যে ওই সব ক্রয়াদেশসহ সব ক্রয়াদেশের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.