চাকরির বয়স ৬ বছর না হলে ইউএনও নয়
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সিনিয়র স্কেল প্রাপ্ত এবং চাকরির বয়স কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে পদায়ন করা যাবে। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে পদায়নের পূর্বে উপযুক্ত কর্মকর্তার তালিকা (ফিটলিল্ট) প্রদান করতে হবে। এসিল্যান্ড হিসেবে কাজ করার পর অন্তত দুই বছর জেলা প্রশাসনে কাজ করতে হবে। এতে একদিকে মাঠ প্রশাসনে কর্মকর্তার সংকট কমবে, অন্যদিকে তুলনামূলক দক্ষতা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে যোগ দিতে পারবেন কর্মকর্তারা।
এছাড়া মাঠ প্রশাসনে ডিসি থেকে শুরু করে এবার প্রশাসনের সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। প্রশাসনকে পেশাগত দক্ষতা, গতিশীলতা ও জনসেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ হিসেবে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার এবং উপসচিব ও তার উপরের কর্মকর্তাদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। নীতিমালার খসড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সচিব কমিটিতে পাঠানো হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। এর আগে আরেকবার সচিব কমিটিতে পাঠালেও সেটি চ‚ড়ান্ত রূপ পায়নি। প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকে এ বিষয়ে কাজ শুরু হলেও নীতিমালা চ‚ড়ান্ত হচ্ছে না। এই নীতিমালার খসড়া চ‚ড়ান্ত করবে সচিব কমিটি। আর সচিব কমিটি মনে করলে এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্যও পাঠাতে পারে।
এদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পেড়িয়ে গেলেও এখনো নিরোপক্ষ প্রশাসন গড়ে উঠনি বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ২০১৫ সালের জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর স্বাক্ষরিত প্রশাসন ক্যাডার নীতিমালা গত ২০২০ সাল থেকে সংশোধনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়। পরে কিছু সংশোধনী দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু দেড় বছর পরে তা এবার নতুন করে বাস্তবায়নে জন্য সংশোধন করা হবে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি বরিশালে ইউএনওর বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনার এবং গত বছর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওপর হামলা হয়। এছাড়া গত কয়েক বছরে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপর বিভিন্ন হামলার ঘটনা ঘটেছে। তার পরে নড়েচরে প্রশাসন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান মিঞা পিএএ ইনকিলাবকে বলেন, আমরা প্রশাসন ক্যাডার নীতিমালা সংশোধনের কাজ শুরু করেছি। মাঠ প্রশাসনে সিনিয়র স্কেলপ্রাপ্ত এবং চাকরির ক্ষেত্রে ও পরিবর্তন থাকছে। এছাড়া ডিসি থেকে শুরু করে প্রশাসনের সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। তবে কবে অনুমোদন হবে তা বলা যাবে না। এবিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, প্রশাসনকে পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং কর্ম সম্পাদনে সদিচ্ছা জনপ্রশাসনের গতিশীলতা ও জনসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ নীতিমালা হচ্ছে। এটি অনুমোদন পেলে সরকারি কাজের গতি ও সেবার মান আরো বাড়বে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, প্রশাসনে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি বন্ধ করতে হবে এবং কর্মকর্তাদের নৈতিক মান উন্নয়ন করতে হবে। এ মুহূর্তে এই দুটি বিষয় জনপ্রশাসনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি বরিশালে ইউএনওর বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিটি মেয়রকে প্রথমে গ্রেফতার, পরে বরখাস্ত করা হবে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে এই পরিকল্পনা প্রায় চ‚ড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন থেকে কঠোর ভাষায় একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। ওইদিন বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার নিয়ে নিয়মিত মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে বিভাগীয় কমিশনারদের বাইরে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ স্থানীয় সরকার, জননিরাপত্তা বিভাগ, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসচিবসহ কয়েকজন সিনিয়র সচিব উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকেও মাঠ প্রশাসনের জুনিয়র কর্মকর্তাদের কার্যক্রমে পরিপক্বতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ কারণে ইউএনও পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম করা হচ্ছে বলে বৈঠকে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম।
বৈঠকে জনপ্রশাসন সচিব জানান, সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) এসিল্যান্ড থেকে সরাসরি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে যাতে নিয়োগ দেওয়া না হয় সেই ব্যবস্থা করছে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, এসিল্যান্ড হিসেবে কাজ করার পর অন্তত দুই বছর জেলা প্রশাসনে কাজ করতে হবে। এতে একদিকে মাঠ প্রশাসনে কর্মকর্তার সংকট কমবে। অন্যদিকে তুলনামূলক দক্ষতা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে যোগ দিতে পারবেন কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে হতে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কর্মজীবন পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে প্রশিক্ষণ। বর্তমানে বিসিএসে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) মনোনয়নপ্রাপ্তরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে চাকরিজীবন শুরু করেন। নতুন এই নীতিমালা চ‚ড়ান্ত হলে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হবে। চাকরিজীবনের সব পর্যায়ে অর্থাৎ পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং, উচ্চশিক্ষা, মর্যাদাপূর্ণ বৃত্তি ও বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত ফল বেশি গুরুত্ব পাবে। অন্যদিকে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে মেধাবী ও চৌকস কর্মকর্তাদের যোগদানে আগ্রহী করতে সর্বোচ্চ প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকছে।
এ ছাড়া কর্মকর্তাদের পদায়নের সুবিধার জন্য সব মন্ত্রণালয়কে পাঁচটি গুচ্ছে ভাগ করা হবে। গুচ্ছগুলো হলো সাধারণ প্রশাসন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, সমাজকল্যাণ ও শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, পড়াশোনাসহ বিশেষ দক্ষতা বিবেচনায় গুচ্ছভিত্তিক মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হবে। প্রতিবছর শূন্যপদের সংখ্যা ও সম্ভাব্য অবসরগ্রহণের সংখ্যা নির্ধারণ করে নতুন নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। খসড়া অনুযায়ী, লিয়েনে ছুটিতে যাওয়ার জন্য আবেদনকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দুর্গম এলাকা বা পার্বত্য জেলায় কর্মরত যোগ্য কর্মকর্তাদের পরবর্তী পদায়ন, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিজেদের সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। পদোন্নতি ও জেন্ডার ভারসাম্যের বিষয়ও প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালায় থাকছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মাঠ প্রশাসনে থাকা কর্মকর্তারা সহজে নিয়ম-কানুনের মধ্যে আসতে চান না। সরকারি কর্মচারী আইন করতে প্রায় ৫০ বছর সময় লেগেছে তা-ও অনেক ভুল আছে। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ক্যাডার নীতিমালা মানসম্মত কিছু হচ্ছে না। তার পরও মন্দের ভালো একটি থাকা দরকার সেটি কবে হবে কেউ জানে না। এ খসড়া পদায়ন নীতিমালায় বলা হয়, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণের সর্বোচ্চ মান বজায় রাখার জন্য দক্ষ, সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বিসিএস প্রশাসন একাডেমি ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিয়াম) মতো প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করা হবে। চাকরি স্থানীয়করণসহ ন্যূনতম ৫ বছর চাকরিকাল না হলে কোনো ক্যাডার কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হবে না।
যেসব কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২ বছর কর্মরত থাকবেন, পরবর্তী পদোন্নতি ও পদায়নে সেটি ইতিবাচক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে। উচ্চতর বৈদেশিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মনোনয়ন পাবেন। প্রকল্পে পদায়নে বলা হয়, প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি হলেই পূর্ণকালীন প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুও গতিশীল করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মচারীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে একজন প্রকল্প পরিচালককে একটি প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর পরই আর একটি প্রকল্পে পরিচালক নিয়োগ করা যাবে না। প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে একবার কোনো বদলির আদেশ ইস্যু হলে যৌক্তিক কারণ ব্যতীত সেটি পালন না করে আদেশ বাতিলের জন্য বাহ্যিকভাবে চাপ প্রয়োগ করলে শৃঙ্খলা ভাঙাজনিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এইকভাবে উপযুক্ত কর্র্তৃপক্ষ লিখিত যৌক্তিক কারণ প্রদর্শন ব্যতীত উক্ত আদেশ অনুযায়ী অবমুক্ত না করলে সেটিও শৃঙ্খলা ভাঙাজনিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যা পদোন্নতির সময় বিবেচনা করা হবে।