বিলুপ্ত ৬৪ মাছের মধ্যে ফিরল ৩১টি
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বলা হয়, মাছে-ভাতে বাঙালি। তবে দিন দিনই বাঙালির পাতে কমে যাচ্ছে দেশি মাছ। ব্যাপক দূষণ ও অতিরিক্ত আহরণসহ নানা কারণে দেশি মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও বহু প্রজাতি হুমকির মুখে। মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩টি ছোট প্রজাতির। এর মধ্যে ৬৪টি মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। গত ২১ বছরে ৩১টি দেশি মাছের চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করে মৎস্যচাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে চলতি বছরেই ১০টি দেশি মাছের জাত বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে উৎপাদন বাড়ানোর উপায় বের করা হয়েছে। সফলতার ধারাবাহিকতায় ৩১তম মাছ হিসেবে গত ২৫ আগস্ট যুক্ত হয় কাকিলা মাছ। এ মাছটির কৃত্রিম প্রজনন বাংলাদেশেই প্রথম।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গবেষণাকাজে সাফল্য আসায় গত ১১ বছরে দেশি ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় সাড়ে চার গুণ বেড়েছে। ২০০৯ সালে পুকুরে চাষের মাধ্যমে দেশি ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ টন, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় তিন লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
পাবদা, গুলশা, গুজি আইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, ট্যাংরা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বৈড়ালি, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, কালবাউশ, কই, বাটা, গজার, সরপুঁটি, গনিয়া, জাইতপুঁটি, পিয়ালি, বাতাসি, রানী, ঢেলা ও কাকিলা- এই ৩১ প্রজাতির মাছ আবার ফিরিয়ে এনেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর মধ্যে ট্যাংরা মাছের দুই রকম জাত রয়েছে। প্রায় এক যুগের প্রচেষ্টায় চলতি বছরের জুন মাসে রুই মাছের নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনের
প্রবৃদ্ধির হার ধীরগতি হলেও গত এক দশকে : বাংলাদেশে এর প্রবৃদ্ধির ধারা ৯.১ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ তিন হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে এক লাখ ১৯ হাজার টন বেশি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ সমকালকে বলেন, পর্যায়ক্রমে সব বিপন্ন প্রজাতির মাছকে কৃত্রিম প্রজননের আওতায় আনা হবে। ফলে ভবিষ্যতে দেশের প্রত্যেক মানুষের খাবারের পাতে দেশি মাছ থাকবে। লাইভজিন ব্যাংকে দেশের বিলুপ্তপ্রায় ৮৮ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। গবেষক, চাষি ও উদ্যোক্তারা যেন সহজেই এ মাছগুলো পেতে পারেন- সে কারণেই এ প্রচেষ্টা।
তিনি বলেন, তাদের গবেষণার ফলে বিলুপ্তপ্রায় দেশি ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে এবং বাজারে দেশি মাছের প্রাপ্যতা সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে ও মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, মৎস্য উৎপাদনে দেশি ছোট মাছের অবদান ৩০-৩৫ শতাংশ। দেশি মাছের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে হ্যাচারিতে দেশীয় মাছের পোনা ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় সব দেশি মাছকে পর্যায়ক্রমে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনা হবে। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরের পৃথক গবেষণায় প্রাকৃতিক উৎসের মাছের বেশ কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদনদীর দূষণ। এ ছাড়া দেশের কৃষিকাজে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ টন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহূত হয়, যা মাটি চুইয়ে জলাভূমিতে যায়।
মাছ নিয়ে গবেষকদের মতে, সরকার ইলিশ রক্ষায় অভয়াশ্রম ঘোষণা ও প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষা করতেও একই ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারিভাবে যেসব মাছ ছাড়া হয়, সেখানে দেশি মাছকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেইসঙ্গে নদীর দূষণ ও দখল বন্ধ করতে জনসাধারণের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ জাগাতে হবে।
অবশ্য দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশের মতো পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায় সরকার। ছোট মাছের প্রজননকাল নির্ধারণ করে ওই সময় তা ধরা নিষিদ্ধ করা হবে। এ জন্য দেশের হাওর, বিল ও নদীর ওপর গবেষণা শেষ হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেওয়া হয়েছে। জুন মাসকে প্রজনন মৌসুম ধরে স্বল্প সময়ের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেউ কেউ অঞ্চলভিত্তিক প্রজনন মৌসুম ঠিক করার কথা বলছেন। তবে সরকার শুরুতে এ নিয়ে পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্প চালু করতে চায়। সফলতা এলে সারাদেশে অভয়াশ্রম চিহ্নিত করে দেশি মাছ রক্ষায় প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে বলে জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব রওনক মাহমুদ।