শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক যেন সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকে ॥ প্রধানমন্ত্রী

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে শিল্প-কলকারখানা, উৎপাদন এবং রফতানি যেন সঠিকভাবে চলতে পারে সেজন্য মালিক-শ্রমিকদের সুন্দর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, আমি সব সময় আমাদের মালিক-শ্রমিকদের একটা অনুরোধই করব, শ্রমিক-মালিকের সম্পর্কটা যেন সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকে। মালিকদের যেমন শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতে হবে, শ্রমের ন্যায্যমূল্য এবং সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি শ্রমিকদেরও দায়িত্ব থাকবে কারখানাটা সুন্দরভাবে যেন চলে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

গত বুধবার সকালে পরিবেশবান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাঝে ‘গ্রীন ফ্যাক্টরি এ্যাওয়ার্ড-২০২০’ বিতরণ এবং চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তন ভবন, মহিলা শ্রমজীবী হোস্টেলসহ ৮ টি নবনির্মিত স্থাপনা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

মালিক-শ্রমিকদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মালিকদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে, এই শ্রমিকরা শ্রম দিয়েই তাদের কারখানা চালু রাখে এবং অর্থ উপার্জনের পথ করে দেয়। আবার সেই সঙ্গে শ্রমিকদেরও এ কথা মনে রাখতে হবে যে, কারখানাগুলো আছে বলেই তারা কাজ করে খেতে পারছেন, তাদের পরিবার- পরিজনকে পালতে করতে পারছেন বা তারা নিজেরা আর্থিকভাবে কিছু উপার্জন করতে পারছেন।

তিনি বলেন, কারখানা যদি ঠিকমতো না চলে তাহলে নিজেদেরই ক্ষতি হবে। কাজেই যে কারখানা আপনার রুটি রুজির ব্যবস্থা করে অর্থাৎ আপনার খাদ্যের ব্যবস্থা করে, আপনার জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে সেই কারখানার প্রতি যতœবান হতে হবে। তবে অনেক সময় দেখি, বাইরে থেকে কিছু কিছু শ্রমিক নেতা বা কোন কোন মহল উস্কানি দেয় এবং একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ৬টি শিল্প খাতের ৩০ প্রতিষ্ঠান বা কারখানাকে এই এ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- পোশাক খাতের ১৫টি কারখানা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতের তিনটি এবং চা শিল্প খাতের চারটি, চামড়া শিল্প খাতের দুটি, প্লাস্টিক শিল্পের তিনটি এবং ওষুধ শিল্প খাতের তিনটি কারখানা। দেশের অর্থনীতির গতিকে বেগবান ও টেকসই করার মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বির্নিমাণ এবং দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণে ‘গ্রীন ফ্যাক্টরি এ্যাওয়ার্ড, ২০২০’ প্রবর্তন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুষ্ঠানে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ৩০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের হাতে গ্রীন ফ্যাক্টরি এ্যাওয়ার্ড ২০২০ তুলে দেন। পুরস্কার হিসেবে মনোনীত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বা কারখানা পেয়েছে ক্রেস্ট, মেডেল, সার্টিফিকেট এবং এক লাখ টাকার চেক। এখন থেকে প্রতিবছর এ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হবে।

পরে প্রধানমন্ত্রী শ্রমজীবী মহিলা হোস্টেল এবং শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের ৮টি নবনির্মিত ভবনও ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ এহছানে এলাহী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কাজের ওপর অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্রও পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী যে স্থাপনাগুলো উদ্বোধন করেন সেগুলো হচ্ছে- নারায়ণগঞ্জ বন্দরে মহিলা শ্রমজীবী হোস্টেল এবং ৫ শয্যার হাসপাতাল সুবিধাসহ শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে ৬ তলাবিশিষ্ট শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তন ভবন, নারায়ণগঞ্জে ৫ তলা ভবনবিশিষ্ট আঞ্চলিক শ্রম দফতর, বগুড়ায় ৩ তলা ভবনবিশিষ্ট শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র ও আঞ্চলিক শ্রম দফতর, গাইবান্ধায় ৩ তলা ভবনবিশিষ্ট শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, বাগেরহাটের মোংলায় ৩ তলাবিশিষ্ট শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, খুলনার রূপসায় ৪ তলা ভবনবিশিষ্ট শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র এবং রাঙ্গামাটির ঘাগড়ায় শ্রম কল্যাণ কমপ্লেক্স।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে এখন বিশ^ প্রতিযোগিতামূলক। এই প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে শিল্প কলকারখানা, উৎপাদন এবং রফতানি যদি সঠিকভাবে চালাতে হয়, তাহলে কিন্তু কারখানাগুলো যথাযথভাবে যাতে চলে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি সেখানে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাহলে রফতানি যেমন বন্ধ হবে, সেখানে কর্মপরিস্থিতি থাকবে না এবং নিজেরাও কাজ হারাবেন। আর তখন বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে ঘুরতে হবে। সেকথা মনে রেখে শ্রমিকদেরকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করতে হবে।

শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে দেশে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৭৭টি ছোট-বড় শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়। এতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেসময় বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করার পাশাপাশি কর্মসংস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমরা সরকারে গঠন করে ৪২টি শিল্প সেক্টরে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছি। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প কারখানাসমূহে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি (স্কেল ভিত্তিক) ৪ হাজার ১৫০ টাকা হতে বাড়িয়ে ৮ হাজার ৩০০ টাকায় নির্ধারণ এবং তৈরি পোশাক শিল্প কারখানাসমূহে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি (স্কেল ভিত্তিক) ১ হাজার ৬৬২ টাকা হতে পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৯৮৫ শ্রমিক ও শ্রমিকের পরিবারকে ৪৩ কোটি ২৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং শ্রমিকের পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করে সেই তহবিল থেকে ৭ হাজার ৯০৫ শ্রমিক ও ৯টি বন্ধ প্রতিষ্ঠানকে ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করার তথ্যও জানান প্রধানমন্ত্রী।

তাঁর সরকার নারীদের জন্য সমান মজুরি নিশ্চিত করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নারী শ্রমিকদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ডরমিটরি নির্মাণ করেছি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ঈশ্বরদীতে ৩টি ডরমিটরি কাম-ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ করেছি। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় মহিলা শ্রমজীবীদের জন্য স্বল্পব্যয়ে নিরাপদ ও মানসম্মত আবাসন নির্মাণ এবং শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।

শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার উদ্যোগের কথা স্মরণ করে তাঁর কন্যা বলেন, জাতির পিতা ১৯৭২ সালে শ্রমনীতি প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি শ্রম পরিদফতর এবং ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন পরিদফতরকে একত্রিত করে শ্রম পরিদফতর গঠন করেন। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে তিনি পরিত্যক্ত কল-কারখানা জাতীয়করণের পাশাপাশি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেন। মজুরি কমিশন গঠন করেন। মে দিবসে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ লাভ করে।

বাংলাদেশের মানুষ যেন আর কষ্টে না থাকে সেজন্য গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার পাশাপাশি সেখানে অর্থের সরবরাহ বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের উন্নয়নটা সমগ্র তৃণমূল পর্যায় থেকে উঠে আসবে, সেভাবে পরিকল্পনা নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কারণ, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে পারে না। স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুত সুবিধা প্রদান এবং গৃহহীনদের অন্তত একটি করে ঘর করে দেয়ার মাধ্যমে ঠিকানা গড়ে দেয়ায় তাঁর অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.