ঝাড়ুদার দিয়েই চলে চিকিৎসাসেবা ! কুড়িগ্রাম ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র

0

আল এনায়েত করিম রনি,কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাষ ইউনিউন স্বাস্থ্য ও পারিবার কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন মিনা রাণী কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাষ ইউনিউন স্বাস্থ্য ও পারিবার কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন মিনা রাণী।
কুড়িগ্রামে ৫৮টি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থাকলেও নেই চিকিৎসক। কিছু কিছু কেন্দ্রে উপসহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ফার্মাসিস্ট থাকলেও তাদের দেখা মেলে না প্রায়ই। সেক্ষেত্রে ঝাড়ুদারই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তাদের অবর্তমানে ৷ আবার কিছু কেন্দ্র বছরের পর বছর থাকে বন্ধ। ফলে কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না গ্রামীণ জনপদের মানুষ।

এসব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (এমবিবিএস), একজন উপসহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, একজন ফার্মাসিস্টসহ অন্যান্য কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে কোথাও নেই স্বাস্থ্য কর্মকতা (এমবিবিএস )। এসব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পোস্টিং পাওয়ার পরেই ডেপুটেশন নিয়ে অন্যত্র চলে যান তারা। বেশির ভাগ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পবিবার কল্যাণ কেন্দ্র চলে এল, এম,এস এস এবং স্টোর কিপার দিয়ে। কিছু কিছু কেন্দ্রে স্বাস্থ্য উপ-সহকারী এবং ফার্মাসিস্ট থাকলেও নিযোমিত আসেন না তারা। সপ্তাহে দুই থেকে একদিন এসে হাজিরা খাতা সই করে চলে যান তারা।

সরেজমিনে জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাষ ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মিনা রাণী নামের একজন মহিলা ভবনে ঝাড়ুদারের কাজ করছেন। পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ করে চিকিৎসাসেবা নেয়ার জন্য আসা মানুষদের ওষুধ দেয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আগতদের সমস্যা শুনে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ দেন তিনি। বিগত তিন বছর থেকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি এমন বেহাল। স্থানীয়দের অভিযোগ ডাক্তার ডেপুটেশন নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। হাফিজুর রহমান নামের একজন উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার এবং একই নামের একজন ফার্মাসিস্ট থাকলেও তারা নিয়মিত আসেন না। ফলে মিনা রাণীই রোগীদের চিকিৎসা দেন। তারা মাঝে মধ্যে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেই চলে যান।

ঝাড়ুদার মিনা রাণী বলেন, তিন বছর থেকে পাঁচশ’ টাকায় ঝাড়ু দেয়ার কাজ করছেন তিনি। রোগীর চাপ থাকলে তিনি ডাক্তার কে সহযোগিতা করছেন তিনি।মাঝে মধ্যে ডাক্তার না আসলে রোগীর ওষুধ দিয়ে থাকেন বলেও জানান তিনি। বল্লভের খাষ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আকমল হোসেন জানান, এই হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার এবং ফার্মাসিস্ট সপ্তাহে দুইদিন আসেন। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে চরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।

নারায়ণপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি জনবল সংকটে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এই ইউনিয়নের বাসিন্দা রাজ্জাক বলেন, বিগত কয়েক বছর আগে সপ্তাহে একদিন করে খোলা হতো এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু একবছর থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি একেবারে বন্ধ রয়েছে। ফলে নদীবিছিন্ন এই ইউনিয়নের মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। কেদার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, তালাবদ্ধ ভবন। জানালার গ্লাস ভাঙ্গা। ভেতরে কক্ষে রোগীদের জন্য দেয়া বেড ধুলাবালি দিয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। অবহেলা আর অযত্নে মরিচিকা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সরকারের দেয়া কোটি-কোটি টাকার সরঞ্জামাদী। এলাকাবাসীর অভিযোগ মাঝেমধ্যে খোলা হলেও দুপুর বারোটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এটি।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার শিলখুড়ি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সামনের জায়গা দখল করে দোকান ঘর তৈরি হয়েছে। সেখানে শুধু মাত্র চলাচলের জায়গা রয়েছে। সরকারি ছুটি ব্যতীত প্রতিদিন খোলার নিয়ম থাকলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিনামূল্যে ২২ প্রকার ওষুধ এই স্বাস্থ্যসেবা থেকে দেয়ার কথা থাকলেও রোগীদের না দিয়ে নিয়মিত বিতরণ দেখিয়ে তা বাইরে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। ইউনিয়নটির চেয়ারম্যান ইসমাঈল হোসেন ইউসুফ বলেন, বহুবার কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা এসব বিষয়ে কর্ণপাত করেন না । তিনি আরও বলেন, সীমান্ত আর নদী ভাঙনপ্রবণ এলাকার গরীব মানুষ সরকারের দেয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি চিকিৎসাসেবা হতে বঞ্চিত হবার পাশাপাশি বাইরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন দারিদ্রপীড়িত এই জনপদের মানুষ।

বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার সিংহভাগ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর একই অবস্থা। কোথাও খোলা হলেও ওষুধ নেই। আবার কোথাও খোলাই হয় না দীর্ঘদিন। ফলে গ্রামীণ জনপদের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত থাকছে বছরের পর বছর।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৮ উপজেলায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অধীনে ৪০টি এবং জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে রুলার ডিসপেনসারি (আরডি) ১৮টি। সেগুলো হচ্ছে- সদর উপজেলার পাঁচগাছি। উলিপুরের দলদলিয়া, দুর্গাপুর ও পান্ডুল। ভূরুঙ্গামারীর শিলখুড়ি, বলদিয়া, চরভূরুঙ্গামারী ও বঙ্গসোনাহাট। নাগেশ্বরীর সন্তোষপুর, ভিতরবন্দ, কেদার ও বল্লভের খাস। রাজারহাটে ছিনাই, বিদ্যানন্দ, উমর মজিদ ও নাজিম খাঁ। চিলমারীর রমনা এবং রৌমারীর যাদুরচর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।

মেডিকেল অফিসার পদ ৩৫টির মধ্যে শূন্য ২১টি। উপ-সহকারী ৪০টি পদের মধ্যে শূন্য ১১টি। ফুলবাড়ির বড়ভিটা, ভাঙ্গামোড় ও কাশিপুর। নাগেশ্বরীর নারায়ণপুর, নুনখাওয়া ও কালিগঞ্জ। চিলমারীর নয়ারহাট। রৌমারীর চরশৌলমারী ও শৌলমারী। ভূরুঙ্গামারীর তিলাই এবং পাথরডুবি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পদ শূন্য রয়েছে। নদী ভাঙনে ইতোপূর্বে বিলীন হয়েছে চিলমারী অষ্টমীর চর, রমনা এবং রাজিবপুরের মোহনগঞ্জ ইউন জনবল সঙ্কট এবং করোনাভাইরাসের কারণে চিকিৎসাসেবা প্রদান কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। দ্রুত এসব সমস্যা কেটে যাবে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.