‘উইমেনস ক্যাফে: টেকসই ভবিষ্যতে নারীর অবদান’

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২

0

নিজস্ব প্রতিনিধি : ‘টেকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগন্য আমরা’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ক্রিশ্চিয়ান এইড আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২ উপলক্ষে আজ বুধবার, ৯ মার্চ বেলা ২.০০টায়. ঢাকা সিটির মহাখালীতে অবস্থিত ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ ‘উইমেনস ক্যাফে: টেকসই ভবিষ্যতে নারীর অবদান’ শীর্ষক একটি জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বন্ধু সোস্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটির পরিচালক- পলিসি এডভোকেসী এন্ড হিউম্যান রাইটস উম্মে ফারহানা জারিফ কান্তা এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মেহের আফরোজ চুমকি, মাননীয় সংসদ সদস্য ও স্থায়ী কমিটির চেয়ারপারসন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম, সামাজিক  , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চার্লস হোয়াইটলি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত এবং প্রতিনিধি দলের প্রধান। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দান করেন ক্রিশ্চিয়ান এইড এর কান্ট্রি ডিরেক্টর পঙ্কজ কুমার ।

বাংলাদেশে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী (দলিত, ট্রান্স জেন্ডার ও হিজড়া, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি) প্রতিনিয়ত নানা বিধ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এই বৈষম্য তাদের শুধু পিছিয়েই রাখেনা বরং সামগ্রিক উন্নয়নকে করে বাধাঁগ্রস্থ। বিশেষত এই জন গোষ্ঠীর নারীরা দু’ভাবে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়; প্রথমত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে, দ্বিতীয়ত নারী হিসেবে। উল্লেখ্য যে, প্রকল্পের থেকে পরিচালিত বেইজ লাইন সার্ভের তথ্যানুসারে, এই জনগোষ্ঠীর নারীরা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা, বিভিন্ন ধরণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। আবার এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সামাজিক রীতিনীতিরকারণে নারীরা সাধারনত সমাজের বাইরে বের হতে পারেনা। এত বাধাঁ বিপত্তি পেড়িয়েও এই জনগোষ্ঠীর কিছু নারী উন্নয়নের বিভিন্ন ধারায় যুক্ত হয়েছে ।

আর্ন্তজাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে ট্রান্স কমিউনিটি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কমিউনিটি, প্রতিবন্ধী, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্ট থেকে কিছু সফল নারীদের গল্প নিয়ে এই ‘উইমেনস ক্যাফে’ অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অথিতির বক্তব্যে মেহের আফরোজ চুমকি বলেন- আমাদের যেতে হবে বহুদূর । আমি ঐসব নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই যারা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে সফল হয়েছে । পিছিয়ে পরা নারীদের উন্নয়নে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী অনেক সুযোগ সৃষ্টি করেছেন । বাংলাদেশে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করাযাচ্ছে । যদিও এর সংখ্যা অনেক কম । বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে । যদি নারীদের তাদের দক্ষতা বাড়ানো যায় তবে তারা পিছিয়ে পরে থাকবেনা ।

বিশেষ অথিতি  চার্লস হোয়াইটলি বলেন; আমি এই অনুষ্ঠানে এসে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি । একটি কথা বলতে চাই, ইউরোপে একটি জেন্ডার বিষয়ক একটি কর্ম পরিকল্পনা রয়েছে যা জেন্ডার সমতা রক্ষায় কাজ করে ।

বিশেষ অথিতি প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম জানান; প্রতিবন্ধীদের জন্য পরিবেশ তৈরী করতে হবে । পিছিয়ে পরা নারীদের সামনে নিয়ে আসতে স্ব স্ব জায়গা থেকে কাজ করতে হবে । তাদের সমান সুযোগ দিতে হবে । এই ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের সৎ ইচ্ছা থাকতে হবে ।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে ক্রিশ্চিয়ান এইড এর কান্ট্রি ডিরেক্টর পঙ্কজ কুমার উপস্থিত সকলকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য । এ সময় তিনি ক্রিশ্চিয়ান এইড এর সকল পার্টনার্স সংস্থাকে ধন্যবাদ জানান ।

‘উইমেনস ক্যাফে’ এর অনুষ্ঠানে কয়েকজন সফল নারী তাদের সফলতার গল্প তুলে ধরে জানান: এম এক্স জয়িতাপলি, প্রতিনিধি, ট্রান্স কমিউনিটি বলেন; পরিবার থেকে অবহেলা ও অনাদর নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা । আমার কারনে আমার মাকেও আমার বাবা প্রতিনিয়ত নির্যাতন করতেন । স্কুলে যখন যেতাম তখন আমার প্রতি সকলের দৃষ্টি ছিলো বৈষম্য মূলক । এভাবেই প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে যুদ্ধ করে এখানে এসে আমি দাড়িয়েছি ।

নাসিমা আকতার, প্রেসিজেন্ট প্রতিবন্ধী নারী বিষয়ক ন্যাশনাল কাউন্সেলর জানান; নিজের কথা বলতে গেলে বলবো অনেক প্রতিকূলতার মাধ্যমে আমি বড় হয়েছি । দুই বছর বয়সে পলিও হয়ে আমার প্রতিবন্ধিত্ব আসে । প্রতিবন্ধী হওয়ার কারনে পরিবারের মধ্যেই আমার প্রতি বৈষম্য শুরু হতে লাগলো । শুধুমাত্র প্রতবন্ধি হওয়ার কারনে আমার বাবা আমার অন্য ভাই-বোনদের স্কুলে পাঠালেন কিন্তু আমি স্কুলে যেতা পারতাম না । পরবর্তীতে আমার পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে আমার মায়ের সহযোগীতায় আমি স্কুলে যাই । খুব কষ্ট করে আমি আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাই । আমি এখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী । অথচ পরিবারে আমার বাবা কোনো দিনই আমার প্রতি একটু সহনভুতি দেখাননি । আমার বাবা আমার ভাইবোনদের নতুন জামা কিনে দিলেও আমাকে কখনো কিনে দিতেন না । তখন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করি সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবার । পরবর্তীতে আমি প্রতিবন্ধী নারিদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলি । এখন আমার বাবা আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন ।

বিচিত্রা তিরকি: ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রতিনিধি জানান- আমি ৮ম শ্রেনীপড়াকালীন ১৯৯৬ সালেআমারবিয়ে হয় । বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার স্বামী মারা যান । তখন আমি ৮ মাসের অন্তসত্বা । এসময় আমার স্বামী কিছু জমি স্থানীয় ভুমি দস্যুরা দখল কওর রেখেছিলো । আমার স্বামীর শেষ কাজ করার সময় আমি তাদের কাছে আমার জমীর বিনিময়ে কিছু টাকা চাইলে তারা আমাকে শারিরিকভাবে নির্যাতন করে । আমি তখন শপথ গ্রহণকরি যে সমতল আদিবাসীদের ভূমি রক্ষায় বিভিন্ন ভূমি দস্যুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো । সেই ধারাবাহিকতায় আমি দীর্ঘদিন ধরে ভূমি দস্যুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছি । বর্তমানে আমি” জাতীয় আদিবাসী পরিষদ” চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সভাপতি হসেবে দায়িত্ব পালন করছি । মানুষের জন্য কাজ করা এই নারী ২০১১ সালে নিজ ইউনিয়ন” পার্বতীপুর” থেকে ”সংরক্ষিত নারী সদস্য” নির্বাচিত হই।

জয়ন্তী রানী দাস: ইউপি মেম্বার, তালা উপজেলা, ইসলাম কাটি ইউনিয়ন, সাতক্ষীরা জানান; আমার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হয়ে সমাজ ও দেশের কল্যানে সমাজ সেবামূলক কাজ করা। কিন্তু বাবা ও মায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল না থাকায় আমি বিএ পর্যন্ত পড়াশনার পর পড়ালেখার সমাপ্তি করতে হয়। আমি একটি বে-সরকারি (এনজিও ব্র্যাক) তে চাকুরী করি। চাকুরীতে উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ করা কালীন অভিজ্ঞতা হতে থাকে নারী ও দলিত জনগোষ্টির লোকজন সমাজে বঞ্চিত, লাঞ্চিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, দরিদ্র ও অসহায়। পরবর্তীতে ২০০৩ সালেনারী ও দলিত জনগোষ্টির ক্ষমতায়ন বিশেষ করে হত দরিদ্র অসচেতন নিরক্ষর অসহায় নারী ও দলিত জনগোষ্ঠির উন্নয়নের জন্য আমি একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি যার নাম উদ্দীপ্ত মহিলা উন্নয়ন সংস্থা । আমি মানুষের সেবায় ব্রত নিয়ে যে পথ চলা শুরু করেছি তার জন্য সকলের নিকট সার্বিক সহযোগীতা কামনা করছি। পরবর্তীতে আমি ২০২১ সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার ০৭ নং ইসলাম কাটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছি ।

হিউমান রাইটস ডিফেন্ডার ও সজাগ সাথী: শুকলেমা খাতুন, অ্যাসিসটেন্ট সুপারভাইজার, এমজিস্টিচ লিমিটেড, রাজেন্দ্রপুর জানান- অনেক অনেক কষ্ট ও সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আমার পথ চলা । অভাবের সংসারে একটু সুখের ছোয়া পাওয়ার জন্য গার্মেন্টসে কর্মী হিসেবে যোগদান করি । অনেক পরিশ্রম ও কাজের প্রতি আনুগত্য থাকার কারনে আজ আমি অনেকটাই সফল । বর্তমানে আমি আমার কোম্পানীর একজন সুপারভাইজার ।

রাশেদা বেগম: উপজেলা ভাইস চেয়ার, চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা জানান; মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার বয়স ছিলো প্রায় ৮ বছর । তখন আমার বাবা কে রাজাকাররা তুলে নিয়ে যায় । তখন থেকেই আমি সংসারের হাল ধরি । মায়ের সাথে কাজ করে সংসার চালাই । পরবর্তীতে আমার বিয়ে হলে আমার শশুরের সহায়তায় আমি আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাই । এসময় আমি ধাপে ধাপে বিএ পাশ করি । এসময় আমি অনুধাবন করি পিছিয়ে পরা নারীদের জন্য কিছু করার । প্রথমে কয়েকজন নারীকে নিয়ে ঠুংগা বানানো শুরু করি । এখন কুমিল্লা শহরে একটি বুটিক্স রয়েছে । যেখানে বেশ কিছু নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে । পরবর্তিতে আমাদের স্থানীয় সংসদ সদস্য  মরহুম মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরনায় উপজেলর নারী ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি এবং নির্বাচিত হই ।

উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ক্রিশ্চিয়ান এইড, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি, নাগরিক উদ্যোগ, ব্লাস্ট এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে Empowering left behind minority communities to effectively participate in the development process of Bangladesh Project (পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ) শিরোনামে এক টিপ্রায় ৪ বছর মেয়াদী প্রকল্প শুরুহয়েছে।এই প্রকল্পটি মূলত দলিত, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হিজড়া ও ট্রান্স কমিউনিটি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য কাজ করে। এই প্রকল্পটির কার্যক্রম রাজশাহী, সিলেট, খুলনা বিভাগের আটটি জেলা সহ ঢাকা শহরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হল, দলিত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত স্থানীয় সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন ও নেটওর্য়াকের সক্ষমতা উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের সুশাসন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণকে সক্রিয় করা।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.