ডলার সংকট মোকাবিলায় ইউয়ানে লেনদেন:দেশের বড় রপ্তানি বাজার হবে চীন!
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সব পণ্য বিনা শুল্কে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় চীনের বাজারে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে দেশের ব্যাংকগুলোকে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজার হতে পারে চীন- মনে করছেন সরকারের রপ্তানিকারক ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। বিশ্বের ৫টি দেশের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ ‘হাই ভ্যালু কারেন্সি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের ইউয়ান তাদের মধ্যে অন্যতম। আইএমএফের কারেন্সি বাস্কেটে ইউয়ান স্বীকৃতি পেয়েছে ২০১৬ সালে। এরপর থেকে আইএমএফের পর্যালোচনায় মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে।
এদিকে চীন হচ্ছে বাংলাদেশের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশ প্রতি বছর চীন থেকে ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য আমদানি করে। কিন্তু এর বিপরীতে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি এখনো এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারেনি। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবসময় ডলার ব্যবহার করে আসছে।
সাবেক ব্যাংকার এবং পর্যবেক্ষক নুরুল আমিন বলেন, ইউয়ান হচ্ছে এমন এটি মুদ্রা যেটি বাংলাদেশ এবং চীন পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করতে পারে। চীনের সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেনের অর্থ হচ্ছে, ডলার সংকটকে পাশ কাটিয়ে আপনি লেনদেন করতে পারবেন, যেটা দুটো দেশ গ্রহণ করবে। তবে চাইলেই ইউয়ানের মাধ্যমে দ্রুত লেনদেন করা যাবে কিনা সেটি নিয়ে সংশয়
আছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, ইউয়ানের দাম কীভাবে নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আসে রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স থেকে। দুটোই আসে ডলারে। তাছাড়া চীনে যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম সেহেতু ইউয়ানের যোগান বেশি থাকবে না। নুরুল আমিন বলেন, আমাদের যদি এক্সপোর্ট বেশি হতো তাহলে ইউয়ান বেশি জমা থাকত। তবে চীনের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে লেনদেন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা দেখবে টাকার মূল্যমানের সঙ্গে ইউয়ানের মূল্যমান কত হয়।
বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নিটওয়্যার রপ্তানিকারক এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, চীনের সঙ্গে ইউয়ানে বাণিজ্য করতে চাওয়া ভালো। কারণ, চীনও ইউয়ানে লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে বিষয়টি কার্যকরীভাবে করা যাবে কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে তারা কত ডলার আয় করছে। বিষয়টিকে তারা সবসময় ডলারের ভিত্তিতেই হিসাব করেন। যারা রপ্তানি করবে তারা হয়তো ইউয়ানে পেমেন্ট না-ও চাইতে পারে। এক্ষেত্রে জটিলতা হতে পারে।
অব্যাহত ডলার সংকটের মুখে গত বৃহস্পতিবার দেশের ব্যাংকগুলোকে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এ সংক্রান্ত এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর অথরাইজড ডিলার শাখা চীনের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে ইউয়ান মুদ্রায় ব্যাংক একাউন্ট খুলতে পারবে। ব্যাংকগুলোর জন্য ইউয়ানে ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট নিষ্পত্তির সুযোগ বাড়বে।
এর আগে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলো চীনা মুদ্রায় বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং একাউন্ট হিসাব রাখতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে ইউয়ানে ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট সেটেলমেন্টের সুযোগ খুলেছে যখন সারাবিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভে ইউয়ান মুদ্রা বাড়াচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নার মধ্যে উভয় মুদ্রা বিনিময় সংক্রান্ত চুক্তি প্রস্তাব করেছে চীন। গত আগস্টে এক চিঠিতে ঢাকার চীনের দূতাবাস জানায়, মুদ্রা বিনিময়ের এই চুক্তি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। একইসঙ্গে কমাবে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন খরচও।
যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীন। দেশটি ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে উঠছে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও আর্থিক বাজারে। জানা গেছে, গত দশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ৩০ শতাংশের বেশি অবদান চীনের। চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যখন সুউচ্চ অবস্থানে তখন দেশটি চাইছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের স্থান দখল করুক তাদের মুদ্রা। আর এতে সায় দিয়ে, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও তাদের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে (ফরেক্স রিজার্ভে) ইউয়ানের পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য বড় তহবিল পাওয়ার অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে চীন। এর মাধ্যমে দেশটি আলোচিত সময়ে বাংলাদেশের শীর্ষ উন্নয়ন সহযোগীর তালিকায় জায়গা করে নেয়। স্বাধীনতার পর চীন থেকে বাংলাদেশে সাহায্যের পরিমাণ ছিল একেবারে শূন্যের কোঠায়। সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে চীন থেকে আসা বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বেড়ে প্রায় ১১ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহৎ দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদার হয়ে ওঠে চীন, তহবিল যোগানের এই প্রবৃদ্ধিকে সুবিশালই বলা যায়। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতে চীনা সংস্থাগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ গত বছর ১৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণে দাঁড়িয়েছে, যার এক-চতুর্থাংশই হয়েছে ইউয়ানে। চীন এখন নিজের বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৫ শতাংশই নিষ্পত্তি করে নিজস্ব মুদ্রায়। ২০১৫ সালেও এই হার ছিল ১১ শতাংশ।