কর্মসংস্থানের সুযোগ
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : নতুন শিক্ষাক্রমে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসছে। নবম ও দশম শ্রেণিতে থাকতেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক কোর্স করানো হবে। জীবন ও জীবিকার এই পাঠ চুকিয়ে মাধ্যমিক স্তর থেকে ন্যূনতম দক্ষতা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পাবে লাখো শিক্ষার্থী। গবেষণার ভিত্তিতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায়, নবম-দশম শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা বিষয়ের কোর্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বৃত্তির (অকুপেশনের) জন্য প্রস্তুত করা হবে। দশম শ্রেণির পর শিক্ষার্থীরা দক্ষতা বিষয়ক পেশায় সরাসরি যোগ দেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করবে।
কোর্সটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীদের বয়স উপযোগী বর্তমান শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আত্মকর্মসংস্থান বা চাকরিতে যোগদানের মতো সক্ষমতা তৈরি হয়। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) রিপোর্ট বলছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি সম্পন্ন করার আগে প্রায় ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে যায়। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে দ্বাদশ শ্রেণি সম্পন্ন করার আগেই ঝরে পড়ার সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ।
পরবর্তীতে এসব শিক্ষার্থী অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। আবার উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পরও অনেক শিক্ষার্থী একইভাবে কোনো রকম পেশাগত প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে ঢুকছে। শিক্ষাধারায় চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করেই নতুন শিক্ষাক্রমে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, কারিগরিতে একটি ট্রেড হচ্ছে অটোমোবাইল। অটোমোবাইলের মধ্যে একটি পেশা হবে শুধু গাড়ি রং করা। আরেকটি অকুপেশন হবে গাড়ির ওয়ারিং, অন্য অকুপেশন হবে গাড়ির ইঞ্জিন। এমন অনেক অকুপেশন মিলিয়ে হবে টোটাল অটোমোবাইল। নবম-দশম শ্রেণিতে এমন ৪০-৫০টি অকুপেশন রাখা হয়েছে। তবে বিভিন্ন এলাকার অবস্থান ভেদে অকুপেশনের চিত্রও বদলে যাবে।
তিনি বলেন, কক্সবাজারের শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে হোটেল ব্যবস্থাপনা। ভোলা এলাকায় থাকবে ফিশ ম্যানেজমেন্ট। কৃষি, গবাদি পশুপালন, খামার, মাছ চাষ এমন অকুপেশন থাকবে গ্রাম অঞ্চলে। বিভিন্ন্ এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অবস্থা ও শিক্ষার্থী বিবেচনায় অকুপেশন বেছে নেবে। তবে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় উল্লখযোগ্য পরিবর্তন আনতে আরও কিছু সময় লাগবে। এ বিষয়ে গবেষণা শেষ হয়েছে। আর কারিগরি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন কারণ এই সেক্টরটি সিলেবাস বুঝলেও কারিকুলাম বিষয়টি এখনও বুঝতে পারে না।
জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমে জাতীয় শ্রম বাজারে সেবা খাতে ৪০ দশমিক ৬১ ভাগ, কৃষি খাতে ৩৭ দশমিক ৭৫ ভাগ ও শিল্প খাতের ২১ দশমিক ৬৫ ভাগ আনুপাতিক অবদান বিবেচনা করে বৃত্তি বা অকুপেশনগুলোর তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। স্থানীয় বা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক খাত ও শ্রম বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্যালয়ের জন্য ধরন নির্ধারণ করা হবে। পদ্ধতিগতভাবে নিয়মিত শ্রম বাজার জরিপ করে নতুন নতুন বৃত্তি (অকুপেশন) প্রণয়ন ও প্রবর্তন করার কথাও শিক্ষাক্রমে বলা হয়েছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাকরির বাজার বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের জীবন ও জীবিকার জন্য প্রস্তুতি রাখা হয়েছে শিক্ষাক্রমে। নতুন শিক্ষা ধারায় মৌলিক, পরিবর্তনশীল ও কর্ম সংশ্লিষ্ট দক্ষতার অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিফলন জরুরি। এর সঙ্গে এক ধরনের পথ-নির্দেশনাও থাকা দরকার। শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থান, যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কর্মপথ পরিবর্তন করে যেন কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।
এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের গবেষক মোঃ রিয়াজ চৌধুরী বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অবশ্যই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা জেনারেল শিক্ষার্থীদের মতোই বাংলা ও ইংরেজি পড়ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে সাধারণ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করা বিষয়গুলো পড়ানো হবে। তবে বিশেষায়িত যেসব বিষয় আছে সেখানকার সাবজেক্টগুলোতে বড় পরিবর্তন আসছে। বিষয়টি নিয়ে এনসিটিবি কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রেক্ষাপট ও চাহিদা বিবেচনায় যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে বিশেষ নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। দেশ ও বিদেশের চাহিদা বিবেচনায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত জনশক্তি সৃষ্টি ও রপ্তানির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করায় এর লক্ষ্য।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়নসহ অন্যান্য শিক্ষাধারার সঙ্গে এর সমন্বয়ের বিষয়েও দিকনির্দেশনা থাকবে। বর্তমান চাকরি বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনশক্তি তৈরি এবং ভবিষ্যৎ কর্ম-বাজারে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা, উচ্চ শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি জাতীয় শিক্ষানীতি ও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতির ওপর ভিত্তি করে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
আগামী বছর থেকে চালু হওয়া শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করে জানা যায়, দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সকল ধারায় প্রাথমিক স্তর থেকে প্রাক-বৃত্তিমূলক এবং তথ্য ও যোগাযোগ (ডিজিটাল প্রযুক্তি) প্রযুক্তি শিক্ষা থাকবে। অষ্টম শ্রেণি পাস করা শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা ধারায় ভর্তি হয়ে ধাপে ধাপে তার নির্বাচিত কারিগরি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। ডিপ্লোমা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করে ক্রেডিট সমন্বয়ের মাধ্যমে স্নাতক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় পড়ার সুযোগও রাখা হয়েছে।
প্রত্যেক শিক্ষা ধারায় কিছু মৌলিক বিষয় বাধ্যতামূলক এবং প্রতিটি ধারার স্বতন্ত্র ও আদর্শ মান বজায় রেখে আরও মান উন্নয়ন করার কথা বলা হয়েছে। সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা বিষয়ের সঙ্গে একটি প্রি ভোকেশনাল কোর্স অন্তর্ভুক্ত হলেও কারিগরি শিক্ষায় তা বর্ধিত কলেবরে হাতে কলমে অনুশীলনসহ থাকবে। সমতার রূপরেখা প্রণয়নের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক আসা-যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায় ৮ম ও ১০ম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের টিভিইটি ধারায় ভর্তির ব্যবস্থাও থাকছে। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট বৃত্তির জন্য প্রস্তুত করা হবে শিক্ষার্থীদের। সাধারণ ও মাদ্রাসা ধারায় সফট স্কিল, প্রি-ভোকেশনাল ও বৃত্তিমূলক (অকুপেশনাল) কোর্সসমূহ এমনভাবে বিন্যস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যাতে এই ধারা দুটিকেও টিভিইটি ইনক্লুসিভ শিক্ষা ধারা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
জাতীয় ও বৈশ্বিক মানদ- অক্ষুণ্ণ রেখে শিক্ষাক্রম রূপরেখায় সকলের জন্য অর্জন উপযোগী ১০টি যোগ্যতা অর্জনের নির্ধারিত মৌলিক বিষয়সমূহ সমন্বয়ের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম কাঠামো বলছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকার এবং বাংলাদেশ গঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিষয়টি রাখা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য কিছু সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছে।
ইসলাম শিক্ষার সুযোগ তৈরি করার পাশাপাশি জীবন ধারণসংক্রান্ত শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হবে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সাধারণ বা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজেদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।
কারিগরি শিক্ষার্থী ও এই সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিবি)। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামছুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডিপ্লোমা কোর্সকে ৪ বছরের জায়গায় ৩ বছর করার কথা বলেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দেখাচ্ছে। যা কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে। আমরা মনে করি কারিগরি শিক্ষা কোনো সিলেবাস নয় যাকে কমিয়ে আনা যায়।
এটি একটি কারিকুলাম। কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন ট্রেড বা বিষয় এখন বেশ পুরাতন। যা এই সময়ে বেশ অপ্রাসঙ্গিক। এই বিষয়গুলো পরিবর্তন করলে অবশ্যই আমরা সাধুবাদ জানাব। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে ৪ বছরের জায়গায় তিন বছর করার পাঁয়তারা করছে তা ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা হতে দেবে না।
এনসিটিবি জানায়, গবেষণার ভিত্তিতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি স্বতন্ত্র বজায় রেখে অন্যান্য শিক্ষা ধারার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার বৈষম্য কমিয়ে আনা হবে। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় যুগের চাহিদা ও ভবিষ্যৎ কর্মজগতের জন্য প্রস্তুতির ওপর জোর দেওয়া হবে।
শিক্ষার্থীরা যেন স্বাস্থ্য সচেতনতা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ডিজিটাল প্রযুক্তিসহ সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে না পরে তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুকে জানার ব্যবস্থা বর্তমান কারিকুলামেও রয়েছে। এখানেও শিক্ষার্থীদের ৭ মার্চের ভাষণ পড়তে হয়। তবে পার্থক্যটা হচ্ছে জাতীয় শোক দিবসে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থাকত।
কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে ঘরে বসে থাকার আর সুযোগ নেই। এই দিনে জাতির পিতাকে নিয়ে গল্প, কবিতা, আলোচনা, স্মৃতিচারণ, নানামুখী উদ্যোগ ও কর্মকা-ের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকবেন। নতুন যে ৬২টি স্কুলে শিক্ষাক্রম পাইলটিং চলছে এসব স্কুলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা, ছবি আঁকা ও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলো। ধারাবাহিকভাবে সামনের বছর থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কার্যক্রম চলবে।