রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : আগামী রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবার তিন মাস আগেই ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ওই সময় বাজারে স্বস্তি ফেরাতে সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছে সরকার। গম (আটা), ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুর ও ছোলার মতো ৭টি ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আমদানিকৃত এসব ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের আমদানি ব্যয় মিটাতে চাহিদামতো ডলারের জোগান পাবেন ব্যবসায়ীরা। আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পঁচিশ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার সরবরাহ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি বাড়াতে সরব হয়েছেন উদ্যোক্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাগের উদ্যোগ নিয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খাদ্যপণ্য আমদানিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত এলসি খোলা শুরু করেছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংকগুলো এই অর্থের জোগান কতটা দিতে পারবেন, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। রোজার চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে চিনি আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর সুপারিশ করা হয়। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তাদের স্বার্থে এ বছর গরু ও খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হতে পারে।

আগামী মার্চ মাসে শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। ওই সময় বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। এবার চিনি, আটা এবং ভোজ্যতেলের ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা করে দ্রুত এসব পণ্যের আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। এ ছাড়া দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চালের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে চাল আমদানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে সংস্থাটি। পেঁয়াজের ঘাটতি থাকলেও মার্চ মাসের আগেই দেশে নতুন পেঁয়াজ ওঠা শুরু হবে। এ কারণে এখন চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের কিছু ঘাটতি থাকলেও রমজানের সময় বাজার তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। রোজায় দ্রব্যমূল্য নাগালের মধ্যে রাখতে ১৫ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোগে একটি ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এই কমিটি আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেবে।

বিশেষ করে রমজানের সময় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারসাজি বন্ধে কাজ করবে সমন্বয় কমিটি। শুধু তাই নয়, রমজানের সময় সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারি সংস্থা টিসিবি’র কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ওই সময় ফ্যামিলি কার্ডের বাইরে ট্রাক সেলে চিনি এবং ছোলার মতো পণ্য বিক্রি করা হতে পারে। এ ছাড়া সারাদেশের এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর টিসিবি থেকে ভোজ্যতলে, চিনি, ডাল এবং পেঁয়াজের মতো পণ্য কিনতে পারবেন। এ কারণে টিসিবির অধীনে খাদ্যপণ্য কিনতে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। অর্থাৎ রমজানের সময় বাজারে স্বস্তি ফেরাতে সব ধরনের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের।

সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রমজানের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানান, আগামী রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের দর বৃদ্ধির এই সময়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এরপরও রোজায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এমন সব খাদ্যপণ্য আমদানিতে ডলারের জোগান দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের ইতোমধ্যে আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলো যাতে দ্রুত এলসি খোলেন সেজন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চিনি এবং ভোজ্যতেলের মতো পণ্যের দাম কমাতে আরও শুল্ক ও ভ্যাট কমাানোর জন্য এনবিআরকে অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়। তিনি আরও বলেন, রমজানে গ্রাহকরা যাতে ভোগান্তির শিকার না হোন সেজন্য খাদ্যপণ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আশা করছি, রমজানের সময় দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক থাকবে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালো।

খাদ্যপণ্য আমদানিতে আড়াই বিলিয়ন ডলারের জোগান দেওয়া হবে ॥ রমজানে খাবার তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এমন সাতপণ্য-ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, অপরিশোধিত সয়াবিন, আরবিডি পাম অয়েল, চিনি এবং গম (আটা) আমদানিতে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জোগান দেওয়া হবে। বাংলাদেশী মুদ্রায় বর্তমান বাজারমূল্যে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি টাকার বেশি। সম্প্রতি এনবিআর থেকে এ সংক্রান্ত একটি ধারণাপত্র বাণিজ্য মন্ত্রণালকে দেওয়া হয়েছে। এতে-চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সম্ভাব্য আমদানি ও আমদানি ব্যয়ের একটি তালিকা তুলে ধরা হয়। যেখানে শুধু ২ লাখ ১০ হাজার মে. টন ছোলা আমদানিতে প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১ লাখ ৫৭ হাজার টন মসুর ডাল আমদানিতে ১৪১ মিলিয়ন ডলার, ৫৯ হাজার খেজুর আমদানিতে ৫৩ মিলিয়ন ডলার, ৩ লাখ ১২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানিতে ৪৩১ মিলিয়ন ডলার, ৪ লাখ ১১ হাজার টন আরবিডি পামওয়েল আমদানিতে ৫৪৪ মিলিয়ন ডলার, ৮ লাখ টন চিনি আমদানিতে ৩৮৬ মিলিয়ন ডলার এবং ২২ লাখ ১৯ হাজার টন গম (আটা) আমদানিতে ৮১২ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে বলে জানানো হয়েছে।

এসব পণ্য দ্রুত আমদানি করতে প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটি। এরপরই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রমজানে ব্যবহার এমন সব খাদ্যপণ্য আমদানিতে দ্রুত এলসি খোলা এবং ডলারের জোগান দেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিরাজমান ডলার সংকটের মধ্যে এলসি প্রক্রিয়া সহজ রাখতে এবং নিত্যপণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল’ গঠন করতে যাচ্ছে। এই সেল থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খাদ্যপণ্য আমদানিতে এলসি খুলছে কিনা সে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ও নিয়মিত সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে নিয়মিত তদারকি করা হবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কোনগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সেই তালিকা করা আছে। সেগুলো আমদানি করতে যাতে কোনো রকম সমস্যা না হয়, সহজে এলসি খুলতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এর মধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে এলসি খোলা সহজ করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রমজান মাস সামনে রেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানি হবে ছোলা, ডাল, খেজুর, ভোজ্যতেল, চিনি ও গমের মতো পণ্য।

পেঁয়াজ মশুর ডাল ও গম আমদানিতে শুল্ক নেই ॥ পেঁয়াজ, মসুর ডাল ও গম আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই। মূলত ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে এনবিআর থেকে তিনপণ্য আমদানিতে সব ধরনের কর ও ভ্যাট ছাড় দিয়েছে। তবে খেজুর আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম করা (এ্যাডভান্স ট্যাক্স-এটি) এবং ৫ শতাংশ (অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স-এআইটি) রয়েছে। অপরিশোধিত সয়াবিন ও অপরিশোধিত পামতেল আমদানিতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত আছে। আন্তর্জাতিক বাজারদর বিবেচনায় বর্তমানে আরোপিত ভ্যাট ১০ শতাংশ ছাড় দিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে। চিনি আমদানিতে শুল্কহার বিদ্যমান রয়েছে। প্রতিটন অপরিশোতি চিনিতে ৩ হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ৬ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয় আমদানিকারকদের। তবে রমজানে দাম কমাতে ভোজ্যতেল ও চিনিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাবের বিষয়টিতে সাড়া দিতে পারে এনবিআর।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ভোগ্যপণ্য আমদানি সহজ করার নির্দেশ ॥ রোজার ইফতার সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার হয় এমন সব ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানি সহজ করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুরের সরবারহ বৃদ্ধি ও মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা সহজ ও নগদ মার্জিন হার কমিয়ে আনতে বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়েছে। ওই সার্কুলারে বলা হয়, ঈদ সামনে রেখে ঋণপত্র খোলা সহজ ও ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। বাজারে যাতে পণ্যের সরবারহ বৃদ্ধি এবং দাম সহনীয় থাকে এর জন্য ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিনের হার ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার নির্দেশনা রয়েছে ওই সার্কুলারে। রোজায় ব্যবহৃত ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুরের মূল্য সহনীয় রাখতে ঋণপত্র খুলতে নগদ মার্জিন কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হবে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
এ ছাড়া রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরও বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করবে সরকার। কোটি পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত ফ্যামিলি কার্ডের বাইরেও এবার ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ট্রাকসেলে চিনি ও ছোলা বিক্রি করা হতে পারে। এলক্ষ্যে টিসিবি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এ ছাড়া দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চাল শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির জন্য আরও তিন মাস সময় বাড়িয়েছে এনবিআর।

সরকারি এসব উদ্যোগের ফলে বাজারে ওই সময় জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী রমজানের আগে গরু ও খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হতে পারে। এর আগে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও গত কয়েক বছর ধরে সংস্থাটি আর দাম নির্ধারণ না করে বরং বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে চাপিয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এবার মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, খাদ্যপণ্য আমদানিতে সর্বোচ্চ নজর দেয়া এ মুহূর্তের জন্য সবচেয়ে ভাল উদ্যোগ। ব্যাংকগুলোকে আমদানি প্রক্রিয়া বিশেষ করে এলসি খোলা সহজ করতে হবে। ডলার সঙ্কটসহ নানা কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। দেশের ছোট বড় ও শীর্ষ স্থানীয় ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকরা এ বিষয়ে অভিযোগ করে আসছিলেন। এবার সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ায় আশা করা হচ্ছে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে খাদ্যপণ্য আমদানি বাড়বে।

আমদানির তুলনা ॥ ২০২১ থেকে ২০২২ সালের (মে থেকে-অক্টোবর) পর্যন্ত আমদানির তুলনা করেছে এনবিআর। এতে চাল ২০২১ সালে ৯ লাখ ৮ হাজার ৬৯৯ টন এবং ২০২২ সালে ৩ লাখ ৫ হাজার ৪৮০ টন আমদানি হয়েছে। এক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৬ লাখ ৩ হাজার ২১৯ টন। গম গত বছর ৩৩ লাখ ৭৪ হাজার ৪০৯ টন এবং এ বছর ১৭ লাখ ২০ হাজার ২৬৬ টন আমদানি। এক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ১৪৩ টন। অপরিশোধিত চিনি গত বছর আমদানি ৮ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৬ টন এবং এ বছর আমদানি ৮ লাখ ৩৫ হাজার ৯৯ টন। এক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৬৪ হাজার ৭৬৭ টন। অপরিশোধিত সয়াবিন গত বছর ২ লাখ ৪৭ হাজার ৮৪০ টন, এ বছর আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ১৬২ টন। বেশি আমদানি ১ লাখ ১১৫ হাজার ৩২১ টন।

পরিশোধিত সয়াবিন গত বছর ৯ হাজার ৮৫৮ টন এবং এ বছর ১৭ হাজার টন। বেশি হয়েছে ৭ হাজার ১৪১ টন। সয়াবিন বীজ গত বছর ৭ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৬ টন এবং এ বছর আমদানি হয়েছে ৮ লাখ ২৪ হাজার ৫৭০ টন। বেশি হয়েছে ৭২ হাজার ৬৯৩ টন। অপরিশোধিত পামওয়েল গত বছর আমদানি ১ লাখ ২৪ হাজার ৫১২ টন এবং এ বছর ১ লাখ ২০ হাজার ৮৪ টন। ঘাটতি ৪ হাজার ৪২৭ টন। পরিশোধিত পামওয়েল গত বছর ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭ টন এবং এ বছর আমদানি হয় ৬ লাখ ৮ হাজার ১৪৬ টন। বেশি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৯ টন। মসুর ডাল গত বছর ১ লাথ ৬৯ হাজার ২২০ টন এবং এ বছর ২ লাখ ১৮ হাজার ২২ টন। বেশি আমদানি হয়েছে ৪৮ হাজার ৮০২ টন। এছাড়া পেঁয়াজ গত বছর আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ১২৫ টন এবং এবছর আমদানি ৩ লাখ ১৯ হাজার ১০৩ টন। ঘাটতি ২১ হাজার ২২ টন।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি যত পদক্ষেপ ॥ বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবেলায় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বিলাস দ্রব্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করণের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৩৩০টি পণ্যের উচ্চহারে শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক চিনি আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার পরিবর্তন করে স্পেসিফিক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তাবিত সমজাতীয় অন্যান্য ভোজ্যতেল যথা-সানফ্লাওয়ার ও ক্যানোলা তেল আমদানিতে উচ্চহারে শুল্কারোপিত আছে যা সয়াবিন ও পামের ন্যায় আরোপ করা হলে সরকারের রাজস্ব কমবে না অন্যদিকে আমদানির উৎস্যে বৈচিত্র আসবে বলে মনে করে। এছাড়া রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের দাম ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখতে ১৫ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দফতর, অধিদপ্তর এবং বেসরকারি খাত একযোগে কাজ করবে। এলক্ষ্যে স্থানীয় সরকার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য, বিদ্যুৎ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, শিল্প, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, ধর্ম, রেলপথ, নৌ-পরিবহন ও বিমান পরিবহন ও পর্যটন, কৃষি, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে একটি সমন্বিত কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মূল্য লক্ষ্য রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি মনিটরিং করা হবে। আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ থাকবে।

আট পণ্যের আমদানি সহজ করার নির্দেশ দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ॥ রমজান সামনে রেখে পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজসহ আবশ্যকীয় আটটি পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ন্যূনতম নগদ মার্জিন রাখার নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে এ হার কত হবে তা ব্যাংক-গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারণের জন্য বলা হয়েছে। আবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের যে তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে, সেখানে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুর রয়েছে। এসব পণ্য আমদানিতে ন্যূনতম মার্জিনে এলসি খোলার সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে সম্প্রতিএকটি সার্কুলার লেটার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ভোগ্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সম্প্রতি আমদানিতে সহযোগিতা দিতে ব্যাংকগুলোকে আরেকটি সার্কুলার দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

রিজার্ভ থেকে ডলার চায় এফবিসিসিআই ॥ রমজানে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার আহ্বান জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। বিশেষ করে রোজার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ঋণপত্র (এলসি) খুলতে রিজার্ভ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ডলার সহায়তা চাওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সম্প্রতিএফবিসিসিআইয়ের একটি প্রতিনিধি দল বৈঠক করেন। সেখানে এসব দাবি জানানো হয়। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, রোজায় নিত্যপণ্য ছাড়াও অনেক পণ্য প্রয়োজন হয়। এজন্য আমদানিটা সহজ করার জন্য বলেছি। প্রয়োজনে এলসি খুলতে রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আশ্বস্ত করেছে। গরুর মাংসের মূল্য নির্ধারণের তাগিদ ॥ গরুর মাংসের মূল্য নির্ধারণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। মাংস ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো মাংসের দাম বাড়িয়ে থাকেন। এ বছর মূল্য নির্ধারণে ব্যর্থ হলে গরু ও খাসির মাংসের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এ কারণে গরু ও খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ হওয়া উচিত। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০-৭২০ এবং খাসির মাংস ৮৫০-৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রমজানের সময় গরুর মাংসের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে দ্রুত নতুন দাম নির্ধারণের করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। মাংস কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস ভোক্তাদের। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বর্তমানে যে দামে বাজারে মাংস বিক্রি হচ্ছে তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশ- ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ভোক্তা হলো দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। কিন্তু ভোক্তার স্বার্থ সার্বিকভাবে দেখা এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন করার জন্য একক কোনো মন্ত্রণালয় নেই। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় ভোক্তা স্বার্থে সরকারি- বেসরকারিখাত সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে। রোজায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।

এদিকে, রোজায় চাহিদা বাড়ায় এমন ছয় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং ন্যায্যমূল্যে বিক্রির বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে সারা বছর ভোজ্যতেলের চাহিদা ২১ লাখ টন, যার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। কেবল রোজার মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে ৪ লাখ টনের মত। সারাবছরের জন্য প্রয়োজন হয় ১৮ লাখ টন চিনি, এর মধ্যে ৩ লাখ টনের চাহিদা থাকে কেবল রোজার সময়। সারা বছর যেখানে ৫ লাখ টন মসুর ডাল লাগে, সেখানে রোজায় চাহিদা থাকে ৮০ হাজার টনের মত। ডালের চাহিদা মেটাতে ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বছরে ৮০ হাজার টন ছোলার প্রয়োজন হয় দেশে, যার ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় রোজার মাসে। এ সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় পেঁয়াজের। ২৫ লাখ টন বার্ষিক চাহিদার ৫ লাখ টনই ব্যয় হয় রোজার সময়।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.