নিষিদ্ধ হলেও নেত্রকোণায় জনপ্রিয় পলিথিন ব্যাগ
মেহেদী হাসান আকন্দ, নেত্রকোণা: প্রায় ২০ বছর আগে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার। কিন্তু ঘুমন্ত ককর্তৃপক্ষের কল্যাণে এখনো জনপ্রিয় বস্তু হিসাবে দাপটের সাথে বিরাজ করছে বাজার করার পিলিথিন ব্যাগ। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ২০০২ সালের জানুয়ারিতে ৫৫ মাইক্রনের চেয়ে পাতলা পলিথিন ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন সেই উদ্যোগ পরিবেশ দূষণ হ্রাসের পথে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হিসাবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।
২০০২ সালের এ নিষেধাজ্ঞার সুফল পেতে সরকার ২০১০ সালে আরেকটি আইন করে। পলিথিনের বদলে পাটের ব্যবহারের জন্য জারি করা হয় পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০। কিন্তু আইনের প্রয়োগ, না থাকার সুফল নিয়ে এখনো পলিথিন ব্যাগ প্রচন্ড প্রতাপ ধরে রেখেছে। এতে জনস্বাস্থ্যসহ মারাত্মক হুমকীর মুখে জীববৈচিত্র।
জেলাশহর সহ ১০টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় কাঁচাবাজার, দোকান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। একবার ব্যবহার শেষে সেগুলো ছুড়ে ফেলা হচ্ছে রাস্তা, ফুটপাত কিংবা ড্রেনে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকীর মুখে। পলিথিনের তৈরি ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও এর ব্যবহার রোধে কর্তৃপক্ষের নজর নেই।
২০০২ সালে সরকারি সিদ্ধান্তে সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে সরকার। ২০১৯ সালের ০১ সেপ্টম্বর ময়মনসিংহ বিভাগকে আনুষ্ঠানিকভাবে পলিথিনমুক্ত ঘোষনা করা হয়েছিল। সে সময় প্রশাসনিক নজরদারী জোরদার থাকায় বাজারে পলিথিনের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হলেও বর্তমানে অসাধু ব্যবসায়ী এবং প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে পলিথিন ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো প্রকার বিধিনিষেধ ছাড়াই সর্বত্র হাতের নাগালেই পাওয়া যায় পলিথিন। ফলে এর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, বাড়ছে দূষণ, ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে একসময় কাগজের ঠোঙা, চটের ব্যাগ, নেটের ব্যাগ ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পলিথিন সহজলভ্য হওয়ায় এসব ব্যাগের চাহিদা কমে গেছে। জেলা শহরের ঘোষের বাজার এলাকার বহর উদ্দিন নামের একজন মাংস ব্যবসায়ী বলেন, আমরা তো পলিথিন ব্যবহার করতে চাইনা। ক্রেতারা সাথে করে ব্যাগ নিয়ে আসেনা। তাই বাধ্য হয়ে তাদেরকে পলিথিন দিতে হয়।
মেছুয়া বাজারের মাছ ব্যবসায়ী রাশিদ জানান, পলিথিনে মাছ নিতে ক্রেতারা বেশি আগ্রহী। বিশেষ করে ব্যাগে অন্য তরকারি থাকায় মাছের গন্ধ বের হবে এমন চিন্তা থেকেই ক্রেতারা ব্যাগে মাছ নিতে চান না। তাই তাদেরকে পলিথিনে মাছ দিতে হয়।
বাজার করতে আসা আব্দুর রহিম বলেন, হাট-বাজারের দোকানগুলোতে পলিথিন থাকে, এজন্য বাজারে আসতে ব্যাগ আনা হয় না। যদি পলিথিন না পাওয়া যেত তাহলে ব্যাগ নিয়ে আসতাম।
সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম বলেন, পলিথিন ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে সমাজ হুমকীর মধ্যে পড়ছে। অপচনশীল পলিথিন একবার ব্যবহারের পর যত্রতত্র পড়ে থেকে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। পলিথিন ব্যবহার বন্ধে আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
নেত্রকোণা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নুরুজ্জামান বলেন, পলিথিন সহজে পঁচেনা। এটি পলিইথাইনিল নামে একটি রাসায়নিক পদার্থ। এটি পানিরোধক বলে জমিতে ব্যাকটেরিয়া তৈরিতে বাঁধা দেয়। পলিথিন মাটিতে না মিশার কারণে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। ফসলের শিকড় ভালোভাবে ছড়াতে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পলিথিন মাটিতে পড়ার কারণে মাটি তার মৌলিকত্ব হারাচ্ছে এবং মাটিতে কোনো ভৌত কাঠামো নির্মাণ করলে তা দুর্বল হতে পারে।
এবিষয়ে নেত্রকোণা ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ অভিজিৎ লোহ বলেন, পলিথিন মানবদেহের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর। পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে চর্মরোগ, ক্যান্সারসহ আরও জটিল রোগ হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পলিথিন ব্যাগকে চর্মরোগের এজেন্ট বলা হয়। পলিথিনে মাছ, মাংস মুড়িয়ে রাখলে কিছুক্ষণ পর এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়ে খাবার বিষাক্ত হয়ে ওঠে। পলিথিনের রঙ করার জন্য ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম মানব শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। উন্নত দেশগুলোয় ক্যাডমিয়াম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফ্রিজে বা স্বাভাবিকভাবে সংরক্ষণের জন্য ঝুঁকিমুক্ত মোটা কাগজ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া আমাদের দেশে বর্তমানে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধাত্বের যে প্রকট সমস্যা তার মূলেও রয়েছে পলিথিনের ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রভাব।
পরিবেশ অধিদপ্তর নেত্রকোণা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি যা পরিবেশের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। ডাস্টবিনে অথবা যত্রতত্র ফেলে রাখা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে জলাবদ্ধতা সৃস্টি হয়। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে ভরাট করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে বায়ু দূষণ ঘটে।
পলিথিন ব্যবহারের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারের পাশাপাশি পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে ভ্রামমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে গত ৩ মাসে ৪৬ কেজি পলিথিন জব্দ, ৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা এবং ৪ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।এছাড়াও ভ্রামমান আদালতের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, নেত্রকোণায় কোন পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানা না থাকলেও একটি প্রতারকচক্র জেলা বাহির থেকে নিষিদ্ধ ক্ষতিকর এই পলিথিন এনে অত্যান্ত গোপনে বাজারজাত করছে। এই প্রতারকচক্রকে সনাক্তের চেষ্টা চলছে। দ্রুত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানান।