‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল, শেষ মুহূর্তে লাগাম
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রতিটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছড়াছড়ি! সবাই এমপি হতে চান। কৌশলগত কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এখন কিছুটা নমনীয় থাকলেও শেষ সময়ে লাগাম টেনে ধরবে আওয়ামী লীগ। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও জমজমাট নির্বাচনের স্বার্থে আপাতত কিছুটা ছাড় দিলেও মনোনয়নপত্র দাখিল শেষে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্র থেকে কঠোর সিদ্ধান্ত আসবে। সময়ের ব্যবধানে কৌশল ও সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট করেই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।
কে কোথায় বা কারা স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকতে পারবেন, আর কোন কোন আসনের কাকে কাকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে গিয়ে দলের প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন- সে ব্যাপারে শীঘ্রই কেন্দ্র থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা যাবে তৃণমূলে। সেই নির্দেশনায় দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলার ব্যাপারে সকল প্রার্থীর উদ্দেশে কঠোর সাংগঠনিক হুঁশিয়ারি থাকতে পারে বলে দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্র থেকে জানা গেছে।
জানা গেছে, শুধু তৃণমূলে সতর্ক বার্তাই নয়, আগামীতে জোট-মহাজোটের আসন ভাগাভাগির বিষয়ে সমঝোতা হলে সেক্ষেত্রে শরিক দল ও মিত্রদের যেসব আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে, সেসব আসন থেকে ঘোষিত প্রার্থীসহ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হবে। সমঝোতার পর জোটের শরিক ও মিত্র দলের নেতারা যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে আসতে পারেন, সেজন্য দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে শরিক প্রার্থীদের অনুকূলে দলীয় প্রতীক নৌকা বরাদ্দ দেওয়া হবে।
আর মহাজোটের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হলে ওইসব আসনে নৌকার প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হবে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে উৎসবমুখর পরিবেশ ধরে রাখতে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারও বিরুদ্ধে এখনই কোনো ব্যবস্থা নেবে না আওয়ামী লীগ।
চারদফা বৈঠক করে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে দুটি আসন বাদে বাকি ২৯৮ আসনে দলের চূড়ান্ত প্রার্থিতা ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এতে প্রার্থী তালিকায় উঠে আসে ১০৪ জন নতুন মুখ, বাদ পড়েন বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদের রেকর্ড সংখ্যক ৭১ জন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। তবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগে তিনশ’ আসনের আওয়ামী লীগের তিন সহস্রাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠকে কেউ যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্কবার্তা প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজনে কিছু আসনে বিকল্প প্রার্থী রাখার নির্দেশনা আসে দলটির হাইকমান্ড থেকে।
এর পরই দলের প্রার্থীদের পাশাপাশি মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের হিড়িক পড়ে যায়। মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান অনেক সংসদ সদস্যও শামিল হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে। বুধবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দলের প্রার্থীদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা দেড় শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। ক্রমশ স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকায় তৃণমূলে দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া, পাল্টাপাল্টি শোডাউনের ফলে দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থি নানা কর্মকা-ের ঘটনাও ঘটছে। ফলে দ্রুতই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লাগাম টেনে ধরতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে তৃণমূলে কড়া নির্দেশনা বার্তা যেতে পারে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম-৭ আসনে নিজের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বুধবার বলেন, সব নির্বাচনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল এবং থাকে। অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিতও হন। তবে আমাদের দলের যারা পদধারী স্বতন্ত্র প্রার্থী, তাদের অবশ্যই দলীয় শৃঙ্খলা মাথায় রাখতে হবে। নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। সময় এলেই সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করবে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই।
এ ব্যাপারে দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থীর বিষয়ে নমনীয় থাকলেও শেষ পর্যন্ত কঠোরভাবে লাগাম টেনে ধরবে আওয়ামী লীগ। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট করতে আপাতত এমন সিদ্ধান্ত থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে তৃণমূলে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেবে দলটি। সেখানেই স্পষ্ট করা হবে কোথায় বা কারা হতে পারবেন ডামি প্রার্থী। এর বাইরে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করলে সাংগঠনিকভাবে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে দলের সেই অবস্থানও স্পষ্ট করা হবে।
এর সঙ্গে রয়েছে জোট শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টিও। শরিকদের ছেড়ে দেওয়া আসনে দলের প্রার্থী বা ডামি প্রার্থী রাখা হবে কি নাÑ তাও সুনির্দিষ্ট করবে আওয়ামী লীগ। তবে এসব বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে আরও কিছুটা সময় নিতে চায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সময়ের ব্যবধানে কৌশল ও সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট করেই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। সেটা মেনে নিয়েই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের মাঠে নামবেন।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রের নেতারা বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী নয়, ডামি প্রার্থীর কথা বলা হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আর ডামি প্রার্থী এক জিনিস নয়। ডামি প্রার্থী জেতার প্রার্থী নয়। এটা বলা হয়েছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে কেউ নির্বাচিত হতে না পারেন। আওয়ামী লীগ চায় উৎসব ও আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যদিয়ে নির্বাচন হোক। স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়ানোর বিধান রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের আগ্রহ আছে, তাদের অনেকেই মনোনয়নপত্র কিনেছেন। কৌশলগত কারণেই আওয়ামী লীগ সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করতে চায়। ফলে সময়ের ব্যবধানে কৌশল ও সিদ্ধান্ত সুনির্দিষ্ট করেই নির্দেশনা দেওয়া হবে। সেটা মেনেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচন করবেন। ফলে এটা নিয়ে চিন্তিত বা বিচলিত হওয়ার সময় এখনো হয়নি।
জানা গেছে, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সূচি পার হলেই জোটের শরিকসহ মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির দরকষাকষি শুরু হবে। শরিকরা সবাই রয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকের অপেক্ষায়। তবে কৌশলগত কারণে আগেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৯৮টি আসনে দলের প্রার্থিতা ঘোষণার পর এক ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছেন জোটভুক্ত দলের অনেক নেতাই। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা কতটুকু শরিকদের কতটুকু ছাড় দেবে, কতটুকু আনুকূল্য দেখাবে- এমন ভাবনাও পেয়ে বসেছে শরিক ও মিত্র দলগুলোর মধ্যে।
১৪ দলের শরিক দলগুলোকে আসন ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে বুধবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদের বলেন, শরিক হলেই তাকে নমিনেশন দেওয়া হবে না। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার যোগ্য প্রার্থী না হলে শুধু শরিক বলেই কাউকে মনোনয়ন দেবে না আওয়ামী লীগ। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি সমন্বয় করা হবে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এর বাইরেও অনিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল নানা জোটে অংশ নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা এখন পর্যন্ত নির্বাচনে না আসার ব্যাপারে অনড় থাকলেও দলটির একটি বড় অংশ স্বতন্ত্র কিংবা অন্য নিবন্ধিত জোটের ব্যানারে নির্বাচন করার জন্য ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন। এতে করে সারাদেশেই নির্বাচনকে ঘিরে অন্য রকম উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। এতে করে নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমেই বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলছেন, আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটের ব্যানারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। শীঘ্রই জোটের শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এর বাইরে নির্বাচনকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে এবং ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে অন্যান্য মিত্র দল এবং বিএনপিসহ অন্যান্য দল থেকে নির্বাচনে আসা প্রার্র্থীদের বিষয়টিও রয়েছে।
এসব প্রার্থী যাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাধার সম্মুখীন না হয়ে নির্বিঘেœ নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারে এবং জনপ্রিয় নেতারা নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে বিজয়ী হলে সেক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাবই দেখাবে আওয়ামী লীগ। তবে এসব দলের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে অতীতের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা হবে কি না, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি। জানা গেছে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত আসন ভাগাভাগির দরকষাকষি চলতে থাকবে। শেষ সময়ে সবকিছু চূড়ান্ত হতে যাবে। তখনো স্পষ্ট হবে জোট, মহাজোট না এককভাবে সবাই নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতায় নামছে। এ জন্য সবাইকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
জাতীয় পার্টি এককভাবেই নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেও অতীতে যেসব সংসদ সদস্যরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন তাদের বড় অংশই চান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সমঝোতার বিষয়টি বহাল থাকুক। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো বিষয়টি নিয়ে কোন স্পষ্ট অবস্থান জানায়নি। ফলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির বর্তমান এমপিদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে।