পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অহংকার বিশ্বের বিস্ময়

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : উত্তাল পদ্মার বুকে বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীক পদ্মা সেতু- একটি স্বপ্নের সেতু। ইতিহাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, বহু বাঁধা পেরিয়ে প্রমত্তা পদ্মাকে বশে এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবিস্মরনীয় বিজয় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফসল। পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের আইকন। একদিন যে সেতু ছিলো এদেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু; তা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের পর আজ বাস্তবে দাঁড়িয়ে আছে।

২০২২ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মাসেতুর উদ্বোধন করেন। স্বপ্নের সেতুর বাস্তবায়নে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের ঝর্ণাধারা। এই সেতু দেশের অবহেলিত দক্ষিণ ও দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগে এক বৈপ্লাবিক পরিবর্তন এনেছে। পাল্টে দিয়েছে জীবনযাত্রা, সূচিত হয়েছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সংযোগ।

পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর দিন ২০২২ সালের ২৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট, স্টিল, কংক্রিটের অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের।’

শুরুতেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে পদ্মাসেতুর নির্মান কাজ। এই সেতু নির্মাণে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর বিরোধিতা ছিলো শুরু থেকেই। এদের সঙ্গে যোগ দেয় বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। দূর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। বিশ্বব্যাংককে অনূসরণ করে এডিবি ও জাইকা সরে যায়।

অনেক নাটকীয়তা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ ও টানটান উত্তেজনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব বাঁধাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষনা দেন। এরপর থেকে নতুন করে আবারো কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। এই স্বপ্নের সেতু নির্মাণের পেছনে ছিলেন বাংলাদেশ, চীন ও ইউরোপের প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রকৌশলী এবং ২০ হাজার শ্রমিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয় প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রাংশ। জার্মানি থেকে হ্যামার, লুক্সেমবার্গ থেকে রেলের স্ট্রিংগার, চীন থেকে ট্রাস ও স্প্যান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা প্রকৌশলীদের পরামর্শক হিসাবেও সহযোগিতা নেয়া হয়। দেশ-বিদেশের প্রযুক্তি, মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। পদ্মাসেতু বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই সেতু হবেই’। পরে ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এই বছরের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৩-২০০৫ সাল পর্যন্ত চলে সম্ভাব্যতা যাচাই। ২০০৬ সালে জমি অধিগ্রহন, পূর্ণবাসন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়। এরপর ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয় এবং সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত নকশা করা হয়। ২০০৯-২০১১ সাল পর্যন্ত বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ চলে। প্রথমে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরবর্তীতে ভবিষ্যতের যোগাযোগ ব্যবস্থা চিন্তা করে শেখ হাসিনা এই সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করতে নির্দেশ দেন। এরফলে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে।
২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে আবারো অনুমোদন পায়। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। ওই বছরই নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে সরকার চুক্তি করে। নদী শাসনের জন্য চীনের অপর প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশনের সঙ্গে একই বছরের নভেম্বর মাসে চুক্তি হয়।

সেতুর দুই দিকে সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো ও টোল প্লাজা নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পায় কয়েকটি দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ১০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর সেতুর মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালে আবারো ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান বসানো হয় এবং ২০২২ সালের ২৫ জুন সেতুর উদ্বোধন করা হয়। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। এই সেতুর পুরো ব্যয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বহন করেছে।

পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিমি বা ৩ দশমিক ৮২ মাইল। সেতুটি ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান নিয়ে নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি পিলারের নিচে ৬টি করে পাইল বসানো হয়। সব মিলিয়ে ২৪০টি পাইল বসানো হয়েছে। ইস্পাতের এসব পাইল মাটির নিচে ৯৬ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি স্প্যান লম্বায় ১৫০ দশমিক ১২ মিটার বা ৪৯২ দশমিক ৫ ফুট এবং চওড়ায় ২২ দশমিক ৫ মিটার বা ৭৪ ফুট। পদ্মাসেতু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোন পর সেতু দৃশ্যমান হতে থাকে। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ৪১ তম স্প্যান বসানোর সঙ্গে সঙ্গে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা সেতুবন্ধনে বাঁধা পড়ে।

পদ্মাসেতুর সুফল পাচ্ছে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষ। পদ্মাসেতু হয়ে পণ্য পরিবহনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন পণ্যবাহী যানবাহনের চালক ও ব্যবসায়ীরা। এই অঞ্চলের যে কোনো জেলা থেকে পণ্য নিয়ে ঢাকায় আসা-যাওয়ায় সময় কমেছে কমপক্ষে ১২ ঘন্টা। একই সঙ্গে দূরত্ব ও সময় কমে যাওয়ায় যানবাহনের ভাড়াও কমেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বরিশাল, খুলনা, পটুয়াখালি, ঝালকাঠি, যশোর, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, বাগেরহাটসহ ২১ জেলার ব্যবসায়ীরাও এখন উপকৃত হচ্ছেন। বরিশাল থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টায়, ঝালকাঠি থেকে ৪ ঘন্টায়, খুলনা থেকে সাড়ে ৪ ঘন্টায়, ফরিদপুর থেকে ২ ঘন্টায় লাখ লাখ মানুষ সহজেই যাতায়াত করতে পারছেন। খুলনা, যশোর, বেনাপোল ও কলকাতার সঙ্গে দূরত্ব কমেছে।

কমেছে পণ্য পরিবহন খরচ। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঝালকাঠি থেকে কাঁচামাল নিয়ে রওয়ানা হয়ে রাত সোয়া ১০টায় যাত্রাবাড়িতে পৌঁছতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। অথচ পদ্মাসেতু চালু হওয়ার আগে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন ফেরিঘাটে সময় কাটাতে হয়েছে। এখন কমপক্ষে ১২ ঘন্টা সময় কমেছে। দক্ষিনাঞ্চলের সব জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ে ঢাকায় পণ্য আনা-নেয়া করতে পারছেন। অথচ পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন মোটেই সহজ ছিলো না।

পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে পায়রা ও মংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচলের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ সহজ হয়েছে। বরিশালের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষে কাজ চলছে।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.