উন্নয়নে ‘হাসিনা মডেল’ : সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের মন্তব্য

0

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ ও স্মার্ট প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার গঠনের দুই মাসের মাথায় গতকাল রবিবার থেকে শুরু হলো জেলা প্রশাসক সম্মেলন, যা সচরাচর ‘ডিসি সম্মেলন’ নামেই পরিচিত। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে নতুন সরকারের লক্ষ্য ও করণীয় সম্পর্কে ধারণা দেয়া হচ্ছে চার দিনব্যাপী এ বছরের ডিসি সম্মেলনে; যা চলবে আগামী বুধবার পর্যন্ত। প্রথম দিনেই যততত্র মাদ্রাসা স্থাপনে কড়াকড়ি, অবৈধ ক্লিনিক বন্ধের মতো বিষয়ে মন্ত্রীরা ডিসিদের সহায়তা চাইলেন। সম্মেলনের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিসিদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনাররা মুক্ত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তা ‘হাসিনা মডেল’ নামে অভিহিত।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাৎসরিক এই সম্মেলনে দেশের ৬৪টি জেলার প্রশাসক ও আটটি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনাররা অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনাসহ তিন বাহিনীর সঙ্গেও মতবিনিময় করবেন ডিসিরা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে কার্য-অধিবেশনও রয়েছে তাদের। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা এবারই প্রথমবারের মতো প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চার নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। এছাড়া স্পিকারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও একটি সমাপনী অনুষ্ঠানও হবে এই সম্মেলনে।

এর আগে গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে চলতি বছরের চার দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের উদ্বোধন করে ডিসিদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম বলেন, দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তা ‘হাসিনা মডেল’ নামে অভিহিত। এরপরে বিকাল ৪টা থেকে ধারাবাহিকভাবে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এই সম্মেলন চলতে থাকে। গতকাল প্রথম দিনেই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ডিসিদের মতবিনিময় হয়। সব মিলিয়ে সম্মেলনে ২৫টি কার্য অধিবেশনসহ মোট ৩০টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনে ডিসিদের দেয়া ৩৫৬টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে।
চিকিৎসায় নানা সংকটের কথা জানালেন জেলা প্রশাসকরা : সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক, জনবল, অর্থ ও অবকাঠামো সংকটের কথা তুলে ধরলেন জেলা প্রশাসকরা। ডিসিরা জানিয়েছেন, অনেক জায়গায় অতিরিক্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। এতে সাধারণ চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে। গতকাল বিকালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ অধিবেশন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, জেলা প্রশাসকরা অনেক জায়গায় জনবল সংকটের কথা জানিয়েছেন। অনেক জায়গায় বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছেন। চাহিদা অনুযায়ী টাকা বরাদ্দ নেই বলেও জানান তারা। তিনি বলেন, ডিসিরা জানিয়েছেন অনেক হাসাপাতালে অপ্রতুল জনবল থাকায় অতিরিক্ত রোগী নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে সাধারণ চিকিৎসাসেবা যে ব্যাহত হচ্ছে এটা তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তাদের আশ্বাস দিয়েছি রাতারাতি নয় তবে আস্তে আস্তে এসব সমস্যা সমাধান করব।

অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে অভিযানে জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা চেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে নির্দেশনা একটাই, আমরা যে অবৈধ হসপিটাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি । এসব প্রতিষ্ঠান তদারকি করতে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে টিম যাবে সেই টিমকে যেন তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জুডিশিয়াল ক্ষমতা নেই, সেটা জেলা প্রশাসকদের আছে। অভিযানটা যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, কোনো বাধা এলে তারা যেন আমাদের অবহিত করেন। রোগীদের ঠিকমতো সেবা না দিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা বলেন, ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের সব জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে মেঝেতে যত রোগী থাকেন, বেডে তত রোগী থাকেন না। এসব রোগীর সেবা দেয়ার জন্য ডাক্তারসহ সংশ্লিষ্টরা আলাদা কোনো বেতন বা সম্মানী পান না। দায় থেকে তারা অতিরিক্ত যে সেবা দিচ্ছেন সেজন্য আমরা তাদের আলাদা গুরুত্ব দেব। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নতুন দায়িত্ব নিয়ে কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করতে হবে। চ্যালেঞ্জ বলতে এইটাই আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করে স্বাস্থ্যখাতকে সুশৃঙ্খল করতে চাই।

অনিবন্ধিত নূরানী মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা হবে : সারাদেশ যত্রতত্র গড়ে ওঠা অনিবন্ধিত মাদ্রাসাগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকরা। তাদের দাবির আলোকে এসব মাদ্রাসাকে নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে সব কিন্ডারগার্টেনকেও নীতিমালার আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গতকাল বিকালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে আলোচনায় অনিবন্ধিত নুরানী মাদ্রাসার বিষয়ও উঠে এসেছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিবন্ধিত মাদ্রাসা প্রক্রিয়ার বাইরে যারা মাদ্রাসা খুলছেন সেটা আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নয়। সেগুলোর বিষয়ে বেফাকের (বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ) সঙ্গে একটা কাজ আমাদের করতে হবে, সেটা হলো একটা বয়সসীমা পর্যন্ত জাতীয় কারিকুলাম যাতে অনুসরণ করা হয়। না হলে আমাদের এই শিক্ষার্থীদের কাক্সিক্ষত, নির্দিষ্ট যোগ্যতা এবং দক্ষতা অর্জিত হবে না।

তিনি বলেন, নিবন্ধনের বিষয়ে পুরো দেশে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্য একটা সার্ভে করেছে। সেই সার্ভে রিপোর্টগুলো নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা কাজ করব। আমি গত বছর কওমি নেতারা ও তাদের সংশ্লিষ্ট বোর্ডগুলোর সঙ্গে বসেছিলাম। আমাদের প্রাথমিক ও নি¤œ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে শিক্ষাক্রম আছে সেই শিক্ষাক্রমের আলোকে যে শিখনফল অর্জিত হয় তা তাদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিশ্চিত হচ্ছে কিনা তা আমরা যাচাই করছি। অভিযোগ আছে এলেই তারা তা পাচ্ছে না। বিদ্যালয় পর্যায়ে দক্ষতা যোগ্যতা না পেলে মাস্টার্স পর্যায়ে সেটা তারা কীভাবে ধরে রাখতে পারবে এটা নিয়ে আলোচনা থাকবেই। আমরা চাই কওমি মাদ্রাসায় যেসব শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে তারা একটি বয়সে ন্যূনতম যে শিখনফল অর্জনের কথা সেটা যেন তারা পায় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করব। তবে তাদেরও কিন্তু কঠোর হতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, জেলা প্রশাসন জানিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় যত্রতত্রভাবে এসব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে জাতীয় কারিকুলামের আলোকে পরিচালিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও আশঙ্কাজনকভাবে উপস্থিতি কমতে দেখা গেছে। সেটা আমাদের সবার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম যখন পরিচালিত হয় সেই সময়টাতে ওইসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা যায় কিনা বা অন্য সময়ে পরিচালিত করা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা আমরা অবশ্যই ভবিষ্যতে চিন্তা করব। তবে অনিবন্ধিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার বাড়বে আর নিবন্ধিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী কমবে সেটা কখনো কাক্সিক্ষত নয়।

নতুন কারিকুলাম নিয়ে জেলা প্রশাসকদের মতামত কী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন কারিকুলাম নিয়ে কোনো নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে বলে তারা জানাননি। তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি রাজধানীর বাইরে প্রান্তিক পর্যায়েও টিচিং লার্নিং প্রসেস অভিভাবকসহ শিক্ষকরা সদরে গ্রহণ করেছেন। জেলা পর্যায়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কমিটি করার কোনো প্রস্তাব এসেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আলোচনা হয়নি। শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, জেলা প্রশাসকরা কারিগরি শিক্ষায় সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিছু কিছু জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথাও বলেছেন। দক্ষতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে আমরা কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করেছি। তারাও (জেলা প্রশাসক) বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শিক্ষায় যে ধরনের অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, শিক্ষকদের এমপিও বৃদ্ধিসহ সর্বোপরি শিক্ষায় যে ধরনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা মাথায় রেখে ব্যবস্থাপনার দিক থেকে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটিসহ আর্থিক বিষয়ে অনেক অভিযোগ প্রায় সময় উঠে তা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়।

এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে সেখানে সুশাসন যেন প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। আমরা এসব বিষয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছি। অনিবন্ধিত কিন্ডার গার্টেনগুলো নীতিমালার মধ্যে আনা প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী বলেন, আগে বিধিমালা না থাকায় অনেক কিন্ডারগার্টেন তৈরি হয়েছে। এখন কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধনের জন্য আমাদের বিধিমালা হয়েছে, তাই আমরা এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব বলে আশাবাদী। আর এই বিধিমালা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকরাও কাজ করবেন বলে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে ডিসিরা কি দাবি জানিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চরাঞ্চল নিয়ে মূলত আলোচনা হয়েছে। নৌকা, বিশেষ ভাতা ও ডরমিটরির কথা তারা বলেছেন। আমরা সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখব।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.