এক্সিমের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে পদ্মা ব্যাংক

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : শরিয়াহ্ভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ব্যাংক দুটির পরিচালনা পর্ষদ এরই মধ্যে একীভূতকরণ প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এ দুই ব্যাংকের মধ্যে আগামী সোমবার সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এটি সই হবে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।

ব্যাংক দুটির পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল এক্সিম ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পদ্মা ব্যাংক অধিগ্রহণের বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন হলে এক্সিম ব্যাংকের একাধিক পরিচালক এর বিরোধিতা করেন। তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়টি অনুমোদন পায়। এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদে প্রস্তাব পাসের পর দুপুরে জরুরি সভা ডাকে পদ্মা ব্যাংক পর্ষদ। সভা থেকে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। পরে ব্যাংক দুটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে জানানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংকটগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংকের যাবতীয় খেলাপি ঋণ সরকার গঠিত একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কিনে নেবে। এতে একীভূতকরণের ফলে দুই ব্যাংকের আমানতকারীদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো ঝুঁকি থাকছে না। আবার পদ্মার কোনো খেলাপি ঋণ না থাকায় এক্সিম ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

একীভূতকরণের মাধ্যমে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে চলতি বছরের শুরুতে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনায় দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে একীভূতকরণের পদ্ধতি ও দায়-দেনা নির্ধারণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এখনো কোনো নীতিমালা ঘোষণা করা হয়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ নীতিমালা জারির প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণের মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন শুরু হবে। একীভূতকরণ শেষে বিলুপ্তি ঘটবে পদ্মা ব্যাংকের। আর ব্যাংকটির বিদ্যমান দায়-দেনা, সম্পদ ও জনবল এক্সিম ব্যাংকের বলে পরিগণিত হবে।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নেতৃত্বে রয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিল। দেশের প্রথম ব্যাংক হিসেবে এক্সিম ব্যাংক পর্ষদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই ব্যাংকের পর্ষদ একীভূত হওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছে। আগামী সোমবার এ বিষয়ে এমওইউ সই হবে। এর পর আনুষ্ঠানিকভাবে পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হবে, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শক্রমে দুই ব্যাংকের আইনজীবীরা ঠিক করবেন।’

প্রায় একই কথা জানিয়েছেন পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারেক রিয়াজ খানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদ সম্মতি দিয়েছে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার রূপরেখা ঘোষণা করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রক্রিয়াটি শেষ হবে।’

তারেক রিয়াজ খান বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংকের আকার বেশ ছোট। এ ব্যাংকের মোট সম্পদ ও দায়-দেনা বড় ব্যাংকগুলোর একটি শাখার সমানও নয়। ব্যাংকের আকার ছোট হওয়ায় একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না।’

দেশে ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে ৪ মার্চ বিএবির একটি প্রতিনিধি দল গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের ছয় মাস সময় দেয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সবল বা দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে বলা হয়। অন্যথায় আগামী জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮-১০টি দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেয়া হবে বলে জানানো হয়।

সে সময় বিএবি নেতাদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, ‘‌আমাদের কাছে তথ্য আছে কোন ব্যাংক ভালো, আর কোন ব্যাংক খারাপ। আপনারা চাইলে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নিতে পারেন। সবল দুটি ব্যাংক একীভূত হয়ে আরো বড় ও শক্তিশালী হতে চাইলে সেটিতেও আপত্তি নেই। ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। একীভূত হলে ব্যাংক শক্তিশালী হয়। নিজেরা একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে আগামী জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার নির্দেশনা দেয়ার পর এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রথম ঘোষণাটি এল। দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ১৯৯৯ সালের ৩ আগস্ট এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (এক্সিম) কার্যক্রম শুরু হয়। শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। তবে বর্তমানে ব্যাংকটির মোট শেয়ারহোল্ডার ইকুইটি ৩ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটিতে জমা রয়েছে গ্রাহকদের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার আমানত। ৪৬ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকার বিনিয়োগ (বিতরণকৃত ঋণ) রয়েছে ব্যাংকটির। সব মিলিয়ে এক্সিম ব্যাংকের মোট সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ৫৪ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। ঋণ খেলাপির পরিমাণ ১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সারা দেশে ব্যাংকটির ১৪৭টি শাখা রয়েছে।

অন্যদিকে পদ্মা ব্যাংক পিএলসির জন্ম ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল। শুরুতে ব্যাংকটির নাম ছিল দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড। নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যাংকটি। ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। ওই সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন। একই সময় অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও। এরপর চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে দ্য ফারমার্স থেকে পদ্মা ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জোগান দিতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি। বর্তমানে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।

২০১৮ সালের এপ্রিলে দেয়া পুঁজির বিপরীতে এখন পর্যন্ত কোনো মুনাফা পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। উল্টো ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত লোকসান মূলধনের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য আর্থিক সূচকে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজিরবিহীনভাবে একের পর এক বিভিন্ন নীতিছাড় দিয়েছে ব্যাংকটিকে। পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিদেশী বিনিয়োগ আনাসহ যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। প্রায় ছয় বছর চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনের পর চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদ থেকে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদত্যাগ করেন।

পদ্মা ব্যাংকের কাছে এখন গ্রাহকদের আমানত রয়েছে প্রায় ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ আমানত থেকে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি, যার বেশির ভাগই এখন খেলাপি। সারা দেশে ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ৬২টি। প্রায় দুই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছে ব্যাংকটির। প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়ে গত মাসে আমানতকে প্রিফারেন্সিয়াল বা অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয় পদ্মা ব্যাংক। এজন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আয়োজন করেছিল ব্যাংকটি। ওই সভায় সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তহবিলের ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত পাস হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান বলেন, ‘গ্রাহকরা না চাইলে আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করা যায় না। ইজিএমে পাস হওয়ার পর আমানতকারীদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। কিন্তু কেউ রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।’

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.