ধুকে ধুকে চলছে জেলেপল্লির জীবন-যাপন
সোম মল্লিক, যশোর প্রতিনিধি : যশোরের অভয়নগর উপজেলার বারান্দী গ্রাম দিয়ে বয়ে গেছে টেকা নদী। সেই নদীর পাশে ছোট একটি ঘর। ঘরে তক্তার বেড়া, ওপরে টিনের ছাউনি। ঘরের সামনের দিকে একটি চৌকি। সম্প্রতি সেখানে বসে ছেঁড়া জাল মেরামত করছিলেন জেলেপাড়ার বাসিন্দা আনন্দ দাস (৫৭) ও অসীম রায় (৩৭)। পাশে বসে তাঁদের সঙ্গে গল্প করছিলেন জেলেপাড়ার শ্রীদাম বিশ্বাস (৮০) ও পঞ্চানন রায় (৬২)।
৫০ বছর জাল টানার পর ২০ বছর আগে ইতি টেনেছেন শ্রীদাম বিশ্বাস। এখন আর তাঁর শরীর ঠিকমতো চলে না। স্ত্রী, ছয় মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। পাঁচ মেয়ে এবং এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে বাক্প্রতিবন্ধী। জমি–জিরাত বলতে তিন শতাংশ ভিটাবাড়ি আর ১৫ শতাংশ ধানের জমি। ইটের তৈরি ছোট একটি ঘর। ছাউনি টিনের। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি সেখানে থাকেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে পাশের টেকা নদীতে মাছ ধরতাম। এই মাছ বিক্রির টাকায় সংসার চলত। নদী এখন শুকিয়ে গেছে। নদীতে তেমন মাছ নেই। ছেলেরা মানুষের পুকুরে ও মাছের ঘেরে মাছ ধরে যা পায়, তাই দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। শরীরও এখন আর ভালো নেই। ওষুধের ওপর শরীর চলে।’
১০ বছর বয়সে স্কুলে গিয়েছিলেন পঞ্চানন রায়। মাত্র ১৬ দিন যাওয়ার পর তিনি আর স্কুলে যাননি। এখন তিনি এলাকার বিভিন্ন পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরেন। ছয়জনের দল। তিনি দলের প্রধান। একদিন মাছ ধরলে ৩৫০ টাকা পান। কোনো কোনো দিন ১০০ থেকে ২০০ টাকাও হয়। চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে তিন ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের পৃথক করে দিয়েছেন। স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে বর্তমানে তাঁর সংসার। ১১ শতাংশ জমির ওপর ছোট একটি কুঁড়েঘর ছিল তাঁর। সম্প্রতি সরকার টিনের ছাউনি দিয়ে দুই কক্ষের একটি পাকা ঘর করে দিয়েছে। সঙ্গে একটি রান্নাঘর ও একটি শৌচাগার আছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন মাছ ধরার কাজ থাকে না। মাসে সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২২ দিন কাজ হয়। আগে টেকা নদীতে বেশ মাছ মিলত। এখন আর তা মেলে না। সব জিনিসের দাম বেশি। অন্যের পুকুরে মাছ ধরে যে মজুরি পাই, তা দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চলে। বেশির ভাগ সময় ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে।’
মাছের ব্যবসা করতেন আনন্দ দাস। ১০ বছর আগে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান তিনি। মাছের ঘের, পুকুর ও নদীতে মাছ ধরার সময় সুতোয় বোনা জাল ছিঁড়ে যায়। ১০ বছর ধরে তিনি সেই ছেঁড়া জাল মেরামত করেন। মাসে ২০ থেকে ২৫ দিন কাজ হয়। সকাল সাতটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করে তিনি মজুরি পান ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ১৭ শতাংশ জমি আছে তাঁর। ওই জমিতে সরকার তাঁকে দুই কক্ষের একটি ঘর বরাদ্দ দিয়েছে। বর্তমানে ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। ঘরের সঙ্গে একটি রান্নাঘর ও শৌচাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। একটি সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলও বসানো হয়েছে। স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল তাঁর সংসার। দুই মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে সাত সদস্যের সংসার তাঁর। তিনি বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। যা আয় করছি, তা দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে না। খুব কষ্টে আছি।’
নদীর পাড়ের ঘরটি মাসে ৪০০ টাকায় ভাড়া নিয়েছেন অসীম রায়। বর্তমানে আটটি জাল আছে তাঁর। ওই জাল ভাড়া দিয়ে দিনে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা আয় হয়। কিন্তু মাছ ধরার সময় জাল প্রায়ই ছিঁড়ে যায়। জাল মেরামত করে আবার ভাড়া দিতে হয়। এতে তাঁর বেশ খরচ হয়। চার শতাংশ জমির ওপর তাঁর ভিটাবাড়ি। মা-বাবা, স্ত্রী, ভাই, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাতজনের সংসার। অসীম বলেন, ‘জাল ভাড়ার টাকা দিয়ে সংসার চলে। তবে প্রতিদিন জাল ভাড়া হয় না। ছেঁড়া জাল মেরামত করতে অনেক টাকা লাগে। সব মিলিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে এখন আর সংসার চলছে না।