পৃষ্টপোষকতা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায় শীতল পাটির কারীগররা
মেহেদী হাসান আকন্দ: শীতল পাটি বাংলার সুপ্রাচীন এক কুটির শিল্পের নাম। শীতল পাটি আমাদের সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া বাংলাদেশের শীতল পাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিক এ স্বীকৃতি ঘোষণা দেয়।
এক সময় সারাবিশ্বে ছিল শীতল পাটির খ্যাতি। আমাদের গৃহস্থালির নানা দরকারি জিনিসের মধ্যে বিশেষ স্থানজুড়ে আছে এ পাটি। গরমের সময় এ শীতল পাটির ঠান্ডা পরশে শান্তি ও ক্লান্তি দূর করে। মানুষের জীবনযাত্রার এক অনন্য অনুষঙ্গ হচ্ছে শীতল পাটি। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এ যুগে এসেও পাটির চাহিদা এতটুকু কমেনি।
শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠে বর্ণিল ফুল, ফল, পশুপাখি প্রিয়জনের অবয়ব এমনকি জ্যামিতিক গাণিতিক নকশাও। শীতল পাটির নকশায় জায়নামাজে ব্যবহৃত হয়েছে মসজিদসহ গুরুতপূ‚র্ণ স্থাপনা। এ শীতল পাটিকে ঘিরে যুগে যুগে কত গান, কত কাব্য রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
“আসুক আসুক মেয়ের জামাই, কিছু চিন্তা নাইরে, আমার দরজায় বিছাই থুইছি , কামরাঙা পাটি নারে” পল্লীকবি জসিমউদ্দীন তাঁর নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে কামরাঙা নামক শীতল পাটির বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন। আগের দিনে যখন বিদ্যুৎ ছিল না, তখন কাঁথা বা তোশকের ওপর মিহি বেতের নকশি করা এক ধরনের পাটি ব্যবহার হতো। তাতে গা এলিয়ে দিলে শরীর বা মনে শীতল পরশ অনুভ‚ত হতো। তাই বোধহয় নাম দেওয়া হয়েছিল শীতল পাটি। শীতল পরশের পাশাপাশি বর্ণিল নকশা সবাইকে মুগ্ধ করে।
শীতল পাটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গৃহায়নের কারুশিল্প। এই খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ ও পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘শীতল পাটি উন্নয়ন অভিযান-২০১৯’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যার প্রতিপাদ্য বিশ্ব জলবায়ু সহায়ক শীতল পাটি ট্যাক্সবিহীন রপ্তানির সুযোগ চাই। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে উন্মুক্ত প্রশিক্ষণ, উৎপাদন, বিপণন ও সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান লক্ষ্য স্থির হয়েছে ।
জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনে ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্বের দরবারে সম্মান সূচক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
নেত্রকোণা জেলায় উন্নত ও উৎকৃষ্টমানের শীতল পাটি তৈরি হয়। জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ের শত শত পরিবার যুগ যুগ ধরে শীতল পাটি তৈরির কাজে জড়িত। তারা সারা বছর ধরে পাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। হাওরের হাতনী, জৈনপুর, কেন্দুয়া, ভাটাপাড়া, নোয়াগাও, হরিপুর, তাহেরপুরের তৈরি শীতল পাটির খ্যাতি রয়েছে দেশ জুড়ে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় বাড়িতে নারী-পুরুষ পাটি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। পুরুষদের তুলনায় নারীরাই এই কাজে বেশি দক্ষ। সাংসারিক কাজ শেষ করে বাঁকি সময়টা তারা পাটি তৈরির কাজেই ব্যস্ত থাকে। স্থানীয়ভাবে পাটি তৈরির কাঁচামাল মুক্তার চাষ হলেও তা যতেষ্ট না হওয়ায় পুরুষরা জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে ঘুরে মুক্তা সংগ্রহ করে।
মুক্তা সংগ্রহকারী হাতনী গ্রামের মৃত খগেন্দ্র দত্তের ছেলে মানিক দত্ত এবং মৃত সুখময় কুমার সরকারের ছেলে শ্যামল চন্দ্র সরকার জানান, বর্ষা মৌসুমে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় অধিকাংশ মুক্তা বর্ষা মৌসুমেই সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া শুস্ক মৌসুমেও মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা, কলমাকান্দা, দ‚র্গাপুর, জাইরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে তারা মুক্তা সংগ্রহ করে স্থানীয় পাটি কারীগরদের কাছে বিক্রি করে।
পাটি তৈরির কারীগর হাতনী গ্রামের সন্তোষ সরকারের স্ত্রী লক্ষী রানী, অনিল ঘোষের স্ত্রী প্রমিলা রানী ঘোষ, মানিক দত্তের স্ত্রী সুগন্ধা দত্ত, শ্যামল দত্তের স্ত্রী সন্ধ্যা রানী ও মদন চন্দ্রের স্ত্রী রেখা রানী এবং জৈনপুর গ্রামের সন্তোষ তালুকদারের স্ত্রী ফুলন তালুকদার, তাদের কলেজ পড়–য়া কন্যা দৃষ্টি তালুকদার, মিনতি তালুকদার, কমলা বনিক জানান, পাটি তৈরি করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। একটি সাধারণ পাটি তৈরিতে তাদের সময় লাগে কমপক্ষে ৩ দিন। প্রতিটি পাটির কাঁচামাল ক্রয় করতে ব্যয় হয় প্রায় ২’শ থেকে ৩’শ টাকা, বিক্রি হয় ৫’শ থেকে ৬’শ টাকায়। তৈরিকৃত পাটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাড়রা এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। আবার স্থানীয় জৈনপুর বাজারে সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার পাটি বিক্রির বাজার বসে। স্থানীয় ব্যবসায়ী কুসু মহন কর, নিপেন্দ্র বনিক ও প্রদীপ দেবনাথ নিয়মিত সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার পাটি ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন বাজাওে বিক্রি করে। পাটি তৈরির কারীগররা জানান, পাটি তৈরির কাঁচামাল মুক্তা সংগ্রহ বর্ষা মৌসুমেই তারা বেশি করে থাকে। নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি সুদে টাকা নিয়ে তারা পাটি তৈরির কাঁচামাল মুক্তা ক্রয় করে। বছর শেষে দাদন ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করতে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এক দাদন ব্যবসায়ীর ঋণের টাকা পরিশোধ করতে অন্য দাদন ব্যবসায়ীর কাছে তাদের ঋণ করতে হয়।
শীতল পাটির কারীগর প্রমিলা রানী ঘোষ জানান, শীতল পাটি তৈরিতে সময় ও খরচ বেশি হওয়ায় কারীগরদের মধ্যে শীতল পাটি তৈরির আগ্রহ কমে যাচ্ছে। উৎকৃষ্টমানের মুক্তা বেশি দামে ক্রয় করতে হয়। এসব মুক্তা থেকে ব্যাত তুলে ভাতের মাড়ের সাথে সিদ্ধ করে প্রথমে রোদে শুকাতে হয় তারপর শুকনো ব্যাত আবারো সিদ্ধ করে রং করে শুকায়ে সুনিপুন হাতে পাটি তৈরি করতে হয়। একটি শীতল পাটি তৈরি করতে প্রায় ১৫ তেকে ২০ দিন সময় লাগে। একটি শীতল পাটি বিক্রি হয় ১৮’শ থেকে ২ হাজার টাকায়া। খরচ এবং পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক অত্যান্ত সীমিত হওয়ায় শীতল পাটি তৈরিতে কারীগরদের মধ্যে অনিহা দেখা দিয়েছে। জীবিকার তাগিদে অনেকেই শীতল পাটির কাজ বন্ধ করে সাধারণ পাটি তৈরি করছে।
অসম্ভব ধৈর্য আর চমৎকার নৈপুণ্যের সমাহারে সমৃদ্ধ একটি শিল্পকর্ম শীতল পাটি বুনন কাজ। এ অঞ্চলে শীতল পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেকে এ পেশা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই এ পেশা হারিয়ে যাচ্ছে।
শীতল পাটি তৈরির কারীগররা জানান, শীতল পাটির কারিগর দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগে শীতল পাটির উপকরণ মুক্তা কিনতে সাধারণত টাকা লাগত না। এগুলো আগাছার মতো যেখানে সেখানে জন্মাত। কারিগররা সেগুলো সংগ্রহ করে পাটি বুনত। শুধু সময় ও পরিশ্রমের দাম হিসেবে এগুলোর মূল্য নির্ধারিত হতো। কিন্তু আজকের পরিবর্তিত সময়ে সবার মাঝে আর্থিক সচেতনতা এসে গেছে। তাছাড়া বর্তমানে মুক্তা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তাই বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সারাবছর পাটি তৈরির জন্য মুক্তা সংগ্রহ করে রাখতে হয়। তাই মুক্তা সংগ্রহে দ্বারস্ত হতে হয় দাদন কারবারীদের নিকট।
তারা ক্ষোভের সাথে জানান, বাংলাদেশের অন্যান্য হস্তশিল্পের মতোই এ শিল্পের শিল্পীরা দরিদ্র ও অবহেলিত। সরকারের অন্যান্য শিল্পের মতো এ শিল্পের দিকে একটু নজর দেয়া উচিত। বিশ্বের দরবারে সম্মান সূচক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এ শিল্প। সারাবিশ্বে এ শীতল পাটি শিল্পের শিল্পীদের কাজে পারদর্শিতার নৈপুণ্য ও শিল্পসত্তার ভ‚য়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। এখন কেন আমরা পিছিয়ে।
শীতল পাটি তৈরির কারীগর মিনতি রানী তালুকদার বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এ পেশায় জড়িত। করোনা মহামারী সংকটের কারণে তাদের তৈরিকৃত শীতল পাটি বিক্রি করে তেমন পারিশ্রমিক আসেনাই। দীর্ঘদিন ধরে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ফলে কারীগররা এখন এ পেশায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। শিল্পটি রক্ষায় সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়ে বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শীতল পাটি তৈরির উৎসাহ বৃদ্ধির পাশাপশি ব্যবসার আরও প্রসার করা সম্ভব হবে। স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে গ্রামের মানুষের বেকারত্ব দ‚র হবে। পাশাপাশি দেশীয় চাহিদা পূরন করে বিদেশে রপ্তানীর সম্ভাবনা তৈরি হবে।