আমি ম্যালা গরিব আমার ছাওয়ালডার পাড়ানির সামর্ত নাই

0

নিজস্ব প্রতিনিধি : আমি ম্যালা গরিব। খুব কষ্ট কইরি ছাওয়ালপাল গুনি লেহেপড়া করাচ্চি। আমার তো আর পাড়ানির সামর্ত নাই। কি করবো বুচতিচিনি। কথাগুলো বলছিল পাবনার সুজানগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম তৈলকুন্ডু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া রাসেলের বাবা আব্দুর রাজ্জাক।

রাসেল এবার (২০২২-২০২৩) সেশনে রুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রাবি, গুচ্ছ বিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েটিং ও বুয়েটে প্রিলিতে টিকে আছে। রাসেল এসএসিতে গোল্ডেন এ প্লাস, ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ৯০% নম্বর পেয়ে এ প্লাস পায়।

রাসেল পাবনার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের তৈলকুন্ডু গ্রামের হতদরিদ্র আব্দুল রাজ্জাক ও মোসা: কমেলা খাতুনের সন্তান। রাসেলের ছোট দুই বোন মোসা: রাবেয়া খাতুন ৯ম শ্রেণি ও মোসা: খাদিজা খাতুন ৪র্থ শ্রেনির ছাত্রী। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে রাসেল সবার বড়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় রাসেলের বাবার থাকার জন্য ভাঙ্গা ঘর ছাড়া আর কিছুই নাই। সে বাড়ির পাশের একটা দোকান থেকে আধা কেজি বাদাম ভাজা আর দুই প্যাকেট নিমকি বাকিতে নিয়ে বাঁকে করে পায়ে হেঁটে সারাদিন বিক্রি করে। দিন শেষে সেই টাকা পরিশোধ করার পর আর যা বাঁচে তাই দিয়ে ৫ জনের ভরন পোষন ও তিন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহন করে। কোনমতে চলে তাদের সংসার।

রাসেলের বাবা আব্দুল রাজ্জাক শেখ অরফে উড্ডু জানান আমি ম্যালা গরিব। খুব কষ্ট কইরি ছাওয়ালপাল গুনি লেহেপড়া করাচ্চি। ঠিকমতো বাত কাপড় দিবির পারিনি। খাতা কলম বই কিনি দিবির পারিনি। খাবির দিবির পারিনি। সপ মানসিই কয় আমার ছাওয়ালডার মাতা খুব ভালো। ঢাহা লাশশাই, আরো কনে কনেযিনি বলে চাঁচ পায়চে। আমার তো আর পাড়ানির সামর্ত নাই। কি করবো বুচতিচিনি। তয় হুনচি বড়লোকরা নাকি গরিব মানিসির ছাওয়ালপাল নিয়ি যায়য়া লেহাপড়া করায়। ঐরহম যদি আমার ছাওয়ালডার কেউ নিয়ি যিয়য়া পড়ালেহা করাতো তালি খুব ভালো ঐতো।

বোনকোলা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ জনাব নূরুল হুদা বলেন রাসেল আমাদের বিদ্যালয়ের একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। সে খুবই গরীব হওয়া সত্বেও এতো ভালো রেজাল্ট করে রুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, গুচ্ছ সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়াতে আমরা গর্বিত। কিন্তু তার পরিবারের পক্ষে কোন ভাবেই রাসেলের পড়ালেখার ব্যয় ভার বহন করা সম্ভব না। তাই আমি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে তারা যদি রাসেলের পড়ালেখার দায়িত্ব নেন, তা হলে রাসেল একদিন দেশে জাতীয় মানব সম্পদে পরিণত হবে বলে আমি মনে করি। আমি রাসেলের সার্বিক মঙ্গলময় জীবন ও ভবিষ্যৎ কমনা করছি।

রাসেলের প্রতিবেশি তৈলকুন্ডু গ্রামের মো: মাসুদ রানা নামের একজন শিক্ষক বলেন রসেলের বাড়ী ঘর ঠিক যেন সেই পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের আসমানীরদের বাড়ি। পাঁচ সদস্যের পরিবারের মধ্যে রাসেল বড় সন্তান। তার অন্য দুই বোনও পড়ালেখা করে। তার বাড়ীতে গিয়ে স্বচক্ষে তার অবস্থা না দেখলে কাউকে বোঝানো যাবেনা তারা দারিদ্র সীমার কতটা কতোটা নিচে আছে। তার এই সাফল্যে আমি এবং আমাদের গ্রামবাসী গর্বিত।

মো: রাসেল বলেন আমি এ বছর ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারিং গুচ্ছ ( রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট ) ভর্তি পরীক্ষায় ২৭৪৬ তম হয়েছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭৩ তম হয়েছি। এছাড়াও সুজানগরের মোমিন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি, বোনকোলা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি ও রাজশাহী শহীদ এ, এইচ, এম কামরুজ্জামান সরকারি ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি।

আমি খুবই দরিদ্র পরিবার থেকে বেড়ে উঠেছি। আমার পরিবারের পাঁচ জন সদস্য। আমি বড় আমি ছাড়াও আমার ছোট দুইটা বোন আছে। একজন ক্লাস ৯ এবং অপরজন ক্লাস পড়ে ক্লাস ফোরে পরে। দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে এই পর্যন্ত এসেছি। খুবই কষ্টকর দিন কাটতো আমাদের এখনও তাই কাটে। আমার দিনগুলো কেমনে কাটতো সত্য বলতে আমি নিজেও জানতাম না। আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর বাবা-মা অনেক আশা করেছে , আমিও স্বপ্ন দেখছি। আমি রুয়েটে মেকানিক্যাল সাবজেক্ট পেয়েছি। আমার স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হাওয়া। আমার বাবার সাধ্য নাই আমাকে পড়ানো। তাই আমি দেশের বিত্তবান বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা প্রার্থনা করছি। তারা যদি আমার স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। সৃষ্টিকর্তা যেন আমার আশা পূরণ করেন।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.