করোনার প্রভাবে হতাশ আর দুশ্চিন্তায় ঈশ্বরদীর লিচু চাষি ও ব্যবসায়ীরা

ঈশ্বরদীর লিচু চাষি ও ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত ।

0

নিজস্ব প্রতিনিধি, পাবনা :  মহামারি প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়েছে লিচুর রাজধানী খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদীতে। মাথায় হাত পড়েছে লিচু চাষির পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের। ইতোমধ্যে আঁটির লিচু বাজারে এসেছে। আর সপ্তাহ খানেক পরেই বোম্বাই লিচু ভাঙ্গা শুরু হবে। গতবারের চেয়ে এবারে ফলন ভালো হলেও করোনা প্রভাবে মোকামগুলোতে নেই কোন কর্মযজ্ঞ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবারই লিচু ভাঙ্গার পূর্বেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকার ব্যবসায়ীরা বাগানে বায়না করে যান। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। বায়না করতে তো আসেননি। কেউ বা বায়না করে আবার টাকা ফেরত নিয়ে গেছে। এ এলাকার বাণিজ্যিক ভিত্তিক লিচু উৎপাদনকারী সহ¯্রাধিক চাষি ও ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা। কার কাছে লিচু বিক্রি করবেন, সে হিসেব মেলাতে পারছেন না। এবারে দেখা দিয়েছে কোটি কোটি টাকা লোকসানের সম্ভাবনা।

এদিকে পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ আব্দুল লতিফ জানালেন, ইতোমধ্যে মন্ত্রী, এমপিসহ উদ্ধর্তন কর্তকর্তাদের সঙ্গে কথা চলছে। কিভাবে এই পরিস্থিতিতে চাষি ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা যায়।

লিচু বাগান মালিকরা জানান, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ফলন ভালো হলেও এবার ক্রেতা নেই। লিচুর ফুল আসা শুরুর পর অনেক বাগান কেনাবেচা হয়েছে। তবে করোনার কারণে লকডাউন শুরুর পর লিচু বিক্রির অনিশ্চয়তা থেকে বাগান দিয়ে আগাম টাকা ফেরত নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। বাগান ফেরত পেয়ে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। বাগান আগাম নেওয়া ব্যবসায়ীরাই লিচুর বাজারজাতকরণ সম্পর্কে ভালো জানেন। তাই বিপুল পরিমাণ লিচু বিক্রি নিয়ে মালিকদের বেগ পেতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক চাষি এবার লিচুর কাঙ্খিত দাম ও বিক্রি নিয়ে শঙ্কায় আছেন।

উপজেলার চাঁদপুর চরের লিচু চাষি আলম হোসেম জানান, ‘প্রায় ১০ বিঘার ৮টা বাগান ইজারা নিয়েছি। সেখানে ১০০টির মতো লিচু গাছ রয়েছে। বাগান প্রতি ইজারা ব্যয় ও কীটনাশকসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও ফলন ভালো। এরইমধ্যে কিছু গাছে লিচু পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এবার ঢাকার পাইকাররা আসবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’

সলিমপুরের লিচু ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের লিচুর বাজার রাজধানী ঢাকা সহ অন্যান্য জেলার ক্রেতা নির্ভর। করোনার কারণে অন্য জেলা থেকে মহাজন, ব্যাপারী ও ফড়িয়ারা এবার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। তাই আমরাও বাগান নেওয়া বা চাষিদের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে আসতে পারছি না। এবার প্রায় বাগানেই ফলন ভালো হওয়ায় ন্যায্যমূল্য নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।’

লিচু চাষি আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউনের আগে অগ্রিম প্রদান করে বাইরের এক পাইকার তাদের একটি বড় বাগান নেন। তবে লকডাউনের কারণে অগ্রিম অর্থ ফেরত নিয়ে গেছেন। এখন বাগান ভর্তি লিচু নিয়ে বিপদে পড়েছি। যারা নিয়মিত ব্যবসায়ী তারা জানেন লিচুর বাজার সম্পর্কে, যা আমার জানার কথা নয়। এখন লিচু কিভাবে বিক্রি করবো সেটাই ভাবছি।’

কামালপুর চর এলাকার চাষি সাকিব আল হাসান সোহেল জানান, তাদের তিন বিঘার বাগানে এবার ভালোই লিচু ধরেছে। এখন পর্যন্ত অর্ধ লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছি কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ। ঝড়-বাদলে লিচুর ক্ষতি না হলে শেষ পর্যন্ত ভালো লিচু ফলন হবে। কিন্ত লকডাউন পরিস্থিতিতে কোন পাইকার লিচু কিনতে না এলে লোকসানে স্থানীয় বাজারে লিচু বিক্রি করতে হবে।

মানিকনগরের লিচু চাষি বাদশাহ প্রামাণিক বললেন, ‘লিচু বাজারজাতকরণ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এমনিতেও পচনশীল হওয়ায় লিচুতে সবসময় ঝুঁকি থাকে, এবার তা অন্যবারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। লিচু আহরণ ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ১০ হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন। লিচুর কোটি টাকার ব্যবসা এবার অনিশ্চিত।’

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এখানে তিন হাজার দুইশ হেক্টর জমিতে লিচুর বাণিজ্যিক বাগান রয়েছে। গাছের সংখ্যা তিন লাখের ওপর। এর মধ্যে দুই লাখ গাছের বয়স ১৫ বছরের বেশি। এ ছাড়া সারা উপজেলাতেই বসতবাড়ির আশপাশেও রয়েছে প্রচুর লিচুগাছ। লিচু চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের হিসাবে বড় গাছগুলোতে এবার নিম্নে ১০ হাজার, ঊর্ধ্বে ২৫ হাজার পর্যন্ত লিচু ধরেছে। অপেক্ষাকৃত ছোট গাছে লিচু এসেছে তিন থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত। বড় গাছে গড়ে ১০ হাজার ও ছোট গাছে ৩ হাজার করে ধরলে এবার লিচুর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি। পাইকারিতে গড়ে প্রতি লিচুর দাম দেড় টাকা ধরা হলেও দাম হয় ৩৪৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে বসতবাড়ির আশপাশের গাছের লিচুর দাম।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ জানান, আঁটির লিচু বাজারে উঠছে। বোম্বে লিচু উঠতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। করোনা পরিস্থির কারণে পন্যবাহী গাড়ির ভাড়া বেশি হওয়ায় এবার লিচুর পাইকার ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলে লিচু ক্রয় করতে আগ্রহ একদমই কম দেখাচ্ছে। তারা এখনও তেমন একটা এ অঞ্চলে আসা শুরু করেন নাই। আমরা মন্ত্রী, এমপি সহ উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে চলেছি। তাদের সমস্ত পরিস্থিতি অবগত করেছি।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.