বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ খুব শিগগির নিজস্ব কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। এছাড়া আরও দুই সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে সরকারের এই স্কিম। তবে কারও কারও মধ্যে স্কিম নিয়ে সন্দেহও রয়েছে। গত ১৭ আগস্ট পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর গতকাল ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৩ হাজার ৪৪৪ জন বাংলাদেশি চাঁদা পরিশোধ করেছেন। এর পরিমাণ ৮ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ টাকা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সর্বজনীন পেনশন-পদ্ধতি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ১৫ বছর পর গত ১৭ আগস্ট সেটি আলোর মুখ দেখে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষকে পেনশন-সুবিধার আওতায় আনা হবে। সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। কর্তৃপক্ষের একটি কার্যালয় দরকার। পেনশন কার্যক্রম শুরু হলেও কর্তৃপক্ষের আলাদা কোনো কার্যালয় নেই, তৈরি করা হয়নি অর্গানোগ্রাম। এজন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় এ স্কিমের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, পেনশন কর্তৃপক্ষকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কাজ চলমান। অর্থ বিভাগের আশা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজস্ব কার্যালয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হবে এবং মনোগ্রামসহ অন্যান্য কাজগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে। আপাতত কাজ চালিয়ে নিতে অর্থ বিভাগের বাজেট ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা উপবিভাগের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানকে কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন একই উপবিভাগের আরেক অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফা। আরও সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।
এ বিষয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা আমাদের সময়কে বলেন, পেনশন স্কিম চালুর পর যারা যুক্ত হয়েছেন তারা স্বতঃস্পূর্ত তাগিদে যুক্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে আরও প্রচারণা দরকার আছে। মানুষকে জানাতে হবে। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে এটা বাড়বে। তিনি বলেন, প্রগতি স্কিমে মানুষের আগ্রহটা বেশি। আর প্রবাস স্কিমে কম। সেখানে কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক প্রবাসীর ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নেই। আবার যাদের আছে সেখানে খরচ একটু বেশি। এসব বিষয়ে কাজ চলছে। এজন্য সিরিজ বৈঠক করছি। তিনি বলেন, খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা নিজস্ব অফিসে কার্যক্রম শুরু করতে পারব।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সর্বজনীন পেনশন একটি জনবান্ধব কর্মসূচি হলেও এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি জটিল। যেসব উন্নত দেশে এই কর্মসূচি সফল হয়েছে, সেসব দেশের অধিকাংশ মানুষের পেনশন স্কিমে চাঁদা দেওয়ার অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের সেই সামর্থ্য নেই। এই কর্মসূচির আওতায় সব কর্মক্ষম নারী-পুরুষকে নিয়ে আসতে হলে ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিকে স্বাগত জানিয়েছেন। সে সঙ্গে তারা জনগণের কাছ থেকে আহরিত অর্থ কোন খাতে ব্যয় করা হবে, সে প্রশ্নও রেখেছেন। যদি এটা উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হয়, তাহলে অর্থনীতি গতিশীল হবে। আর অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হলে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, এটি অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। তবে ফান্ডের টাকা কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে সেটি দেখা দরকার। তা না হলে মানুষের টাকা ফেরত দিতে টাকা প্রিন্ট করতে হবে। ফান্ডের টাকা তিনি বহুজাতিক ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন।
সম্প্রতি ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা এমসিসিআইয়ের এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান বলেন, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির চাঁদার অর্থ নিরাপদ খাতেই বিনিয়োগ করা হবে। প্রাথমিকভাবে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে এ অর্থ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের অধীনে দুটি তহবিল থাকবে। একটি তহবিলে সরকার সরাসরি অর্থ দেবে। সেই অর্থ দিয়েই জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অফিসের ব্যয় বহন করা হবে। অন্য তহবিলে জমা হবে পেনশনের চাঁদার অর্থ। সেই অর্থ কোথায় বিনিয়োগ হবে, সেটি নির্ধারণ করবে তহবিল ব্যবস্থাপনা কমিটি। সেই কমিটিতে ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিসহ অনেকে থাকবেন। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত ও নিরাপদ জায়গায় বিনিয়োগ করা হবে, যাতে করে এ অর্থ সুরক্ষিত থাকে এবং মুনাফাও হয়। ভবিষ্যতে একসময় এই তহবিলে অর্থ জমা অনেক বেড়ে যাবে।
অর্থ বিভাগের মতে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শুরুতে চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়। এগুলোর নাম হচ্ছে প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাসী’ এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’ শীর্ষক কর্মসূচি চালু করা হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ পেনশনব্যবস্থার বাইরে রয়েছেন। সে কারণে ধারণা করা হয়েছিল যে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মতো একটি সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচিতে বেশ দ্রুত সাড়া পাওয়া যাবে। পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা অবশ্য মনে করেন, এ ধরনের একটি কর্মসূচির মূল্যায়নের জন্য এক মাস খুব বেশি সময় নয়।
এদিকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রথম নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খান, যাকে এ পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন তাকে পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে একটি সারসংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানা গেছে। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সারসংক্ষেপটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সম্প্রতি এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একটি চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনায় আইন অনুযায়ী, একটি ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করার কথা উল্লেখ রয়েছে এবং এর প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। কর্তৃপক্ষের একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য থাকবেন এবং তারা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। তাদের চাকরির মেয়াদ ও শর্ত বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন নির্বাহী চেয়ারম্যান। কর্তৃপক্ষসহ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার বহন করবে। গঠিত কর্তৃপক্ষ স্থাবর বা অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন, সম্পত্তি অধিকারে রাখতে ও হস্তান্তর করতে পারবে এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে নিজ নামে ঋণ নিতে পারবে। কর্তৃপক্ষ নিজ নামে মামলা দায়ের এবং আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব ক্রোক করতে পারবে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও মামলা দায়েরের সুযোগ রাখা হয়েছে আইনে।
অন্য দিকে, অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি পেনশন পরিচালনা পর্ষদও গঠন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, এফবিসিসিআই সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি প্রমুখ এর সদস্য হবেন।