প্রবীর সাহা : দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও পাবনার স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছে অনেক কম। তারপরও গত কয়েক দশকে জেলার স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। প্রশংসনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ও অবকাঠামো। কিন্তু ওষুধ সরবরাহে অপর্যাপ্ততা, চিকিৎসক সংকট, অন্যান্য জনবলের অভাব, যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণের দূর্বলতা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং সুসংগঠিত রেফারেল পদ্ধতি না থাকায় এখানকার স্বাস্থ্য কাঠামোর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
ঐতিহ্যবাহি পাবনা ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জেলার বেশিরভাগ অংশ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাবনা জেলা অনেক আগে থেকেই প্রসিদ্ধ। এখানকার ওষুধ শিল্পও উল্লেখ করার মত। এখানকার স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস দেশের পাশাপাশি বিশ্ব বাজারেও স্থান করে নিয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবার জন্য পাবনায় রয়েছে ৫০০ শয্যার বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতাল , পাবনা জেনারেল হাসপাতাল, পাবনা মেডিকেল কলেজ, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। পরমাণু শক্তিকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে আগামী জুনে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স (ইনমাস)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর দেশে ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে, আর বড় ধরনের আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে সোয়া দুই কোটি মানুষ। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ৬০ শতাংশের বেশি চলে যায় মূলত ভৌত অবকাঠামো, পরিচালন ব্যয় ও বেতন ভাতায়। তারপরও সরকারি হাসপাতালের কথা বলতেই ভেসে উঠে ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জনভোগান্তি, দালাল-হকারদের দৌরাত্মসহ মানবিক অসহায়তার করুণ দৃশ্য।
এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয় পাবনা জেলা স্বাস্থ্য খাতও। জেলার জনসংখ্যার বড় অংশ গ্রামে বসবাস করলেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবার মান এখনো সীমিত। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালই একমাত্র ভরসাস্থল। শিশুদের জন্য পাবনায় বিশেষায়িত কোন চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র না থাকায় শিশু স্বাস্থ্য হুমকির সম্মূখীন।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ভর্তি থাকে। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগ থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০০ রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। রোগী অনুপাতে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য জনবল কম থাকায় রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগীকে মেঝেতে বিছানা পেতে থাকতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে কিছু চিকিৎসক উন্নতমানের পরীক্ষার কথা বলে রোগীদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার জন্য পাঠাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন। বেসরকারিভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি অনেক বেশি হলেও চিকিৎসকেরা দালালচক্র ও বিভিন্ন এলাকা থেকে পল্লী চিকিৎসকদের পাঠানো রোগীদের থেকে পরীক্ষার কমিশন নেয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর চিকিৎসা সেবার ওপর ভরসা করতে না পেরে রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিকে যাচ্ছেন।
পাবনা সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী বলেন, পাবনা মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল স্থাপন হলে পাবনার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো উন্নত ও গতিশীল হবে।
পাবনা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি হাসপাতাল ১৭ টি, বেসরকারী ক্লিনিক ১০১ টি, কমিউনিটি ক্লিনিক ২৬১ টি। কমিউনিটি ক্লিনিকেক মিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার পদ শূন্য আছে ৮ টি। পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসকের ৩১ টি পদের মধ্যে ২১ টিই বর্তমানে শূন্য। মাত্র ১০ জন চিকিৎসক নিয়ে ঢিমেতালে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে হাসপাতালটিকে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট থাকায় চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে জানিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. শাফকাত ওয়াহিদ বলেন,এমনিতে বাংলাদেশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। যারা আছেন তারা সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকার কারনে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছেন।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা: মো: ওমর ফারুক মীর জানান হাসপাতালে মোট চিকিৎসকের পদ সংখ্যা ৫৯, অথচ সেখানে আছেন ৫০ জন।
প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। অবেদনবিদ সংকট থাকায় অস্ত্রোপচার কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। তবে হাসপাতালটিতে আছে নিরবিচ্ছিন্ন অক্সিজেন সেবা। আছে ডিজিটাল এক্স-রে, ও আধুনিক সিটিস্ক্যান মেশিন।
জেলার ৯ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য সেবায় আধুনিকতার ছোয়া তেমন লাগেনি। কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকা সত্বেও প্রায়ই সেগুলো অকেজো থাকে। তবে সমগ্র জেলায় ১০১টি প্রাইভেট ক্লিনিক আছে যেগুলো সব সময় সচল আছে।
পাবনা পৌর এলাকায় স্কুল হেলথ ক্লিনিক থাকলেও তা জানেনা অধিকাংশ শিক্ষার্থী। সেখানে দুজন চিকিৎসক সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের সেবা প্রদান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা পরামর্শ প্রদান করে থাকে।
পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে আগের মত গতি নেই বললেই চলে। ঘরে ঘরে যাওয়ার একটা উদ্যোগ ছিলো সেটাও আগের মত কার্যকর নয়। সংক্রামক রোগ ও অসংক্রামক রোগ নিয়ে আলাদা উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
বক্ষব্যাধি হাসপাতাল মোটামুটি স্বাস্থ্য সেবা দিলেও সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি আছে।
তবে পৌরসভার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র টিকা প্রদানের জন্য কিছুটা হলেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
অতিমারি করোনাকালে সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়েই পাবনায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন চিকিৎসকরা। পাবনা জেনারেল হাসপাতাল হয়ে ওঠে একটি দৃষ্টান্ত। যথাযথ প্রশাসনিক পদক্ষেপ, সশস্ত্র বাহিনী ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল ভূমিকা, চিকিৎসা সেবাদানে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের আন্তরিকতা এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে জেলাটিতে দেশের অন্য জেলাগুলোর তুলনায় মৃত্যু হার কম এবং সুস্থ্যতার হার আশাপ্রদ।
পাবনার নাগরিক সমাজের অন্যতম ব্যক্তি, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি পাবনা জেলা শাখার ভাইস-চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বিশ্বাস বলেন, জেলায় যেসব হাসপাতাল আছে সেগুলোকে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আধুনিকিকরণের পাশাপাশি চিকিৎসক সংকট নিরসন করে সেবার মান বাড়াতে হবে।
(এই প্রতিবেদনটি বিএনএনআরসির তত্বাবধানে স্বাস্থ্য সাংবাদিকতায় মিডিয়া ফেলোশিপের আওতায় তৈরি)