নিজস্ব প্রতিনিধি : ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগের প্রেক্ষিতে পাবনা সিভিল সার্জনের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন।
মিরা খাতুনের বয়স ২২ বছর। গ্রামের বাড়ি পাবনার বেড়া উপজেলার ফুলতলায়। পার্শ্ববর্তী সাঁথিয়া থানার মো: শাহীন আলীর সাথে বিয়ে হয় ২০২০ সালের মাঝের দিকে। স্বামীর গার্মেন্টসে চাকুরির কারণে থাকতেন ঢাকার আশুলিয়ায়। গতবছর এপ্রিলের ১০ তারিখে পেটে ব্যাথা অনুভব করেন। দালালের খপ্পরে পড়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বায়োপসি বা এফএনএসি ছাড়াই ক্যান্সার অপারেশনে মৃত্যু হয় তার। সম্প্রতি এ বিষয়ে চিকিৎসক ও ক্লিনিক মালিকের বিচার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে অভিযোগ দায়ের করেছেন তার স্বামী মো: শাহীন আলী।
তার দাবী, স্ত্রীর চিকিৎসার সন্ধান করতে গিয়ে সে পরে যায় দালালদের খপ্পরে। তার শশুরবাড়ী এলাকার আনিছুর রহমান তাকে কম খরচে ভালো চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকা থেকে নিয়ে যায় ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন সেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ঐ ক্লিনিকের মালিক মো: উজ্জ্বল হোসেন ও ডা. সাইদুজ্জামান (উপল) মিলে মিরা খাতুনের ভুল অপারেশন করে। হাতিয়ে নেয় লক্ষাধিক টাকাও।
ডা. সাইদুজ্জামান উপল প্রথমে রোগী ক্লিনিকে ভর্তি করার পর মিরার স্বামী শাহীন আলীকে জানায়, তার স্ত্রীর ডিম্বাশয় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েছে, যা মূত্রথলি এমনকি পেটের সামনের দেয়াল পর্যন্ত ছরিয়ে গেছে। দ্রুত অপারেশন না করলে রোগিকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এমন ভয়াবহ খবর দিয়ে স্বল্প শিক্ষিত স্বামী মোঃ শাহিনকে হতবিহ্বল করে ফেলে। সে তার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য সম্পদ বিক্রি করে টাকা যোগার করে ঐ ক্লিনিকেই অপারেশন করতে বাধ্য হোন। নিয়ম মাফিক এরকম অপারেশনের জন্য জেনারেল এনেস্থেসিয়া দেয়ার প্রয়োজন হলেও সাব এরাকনয়েড ব্লক নামক লোকাল এনেস্থেসিয়া দিয়েই ২০২২ সালের ১০ মে টানা তিন ঘণ্টা ধরে অপারেশন করা হয়। অপারেশনে দুইটি ডিম্বাশয়ই কেটে ফেলার পাশাপাশি ক্ষুদ্রান্ত্র ও মুত্রথলির কিছু অংশ কেটে ফেলে দিয়ে আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে শুরুতে মিরাকে সারা জীবনের জন্য মা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে বন্ধ্যা করে ফেলা হয়।
এতে রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। অপারেশনের জায়গায় পুঁজের সৃষ্টি হয়, দুর্গন্ধ ছড়ায়। এ সময় আনিছ নামের ঐ দালাল পালিয়ে যায়। শাহীনের কাছের সব টাকা শেষ হয়ে গেলে ডা: সাইদুজ্জামান ও ক্লিনিক মালিক উজ্জ্বল মিলে রোগীকে অমানবিকভাবে ক্লিনিক থেকে তাড়িয়ে দেয়। তাঁর অসহায় স্বামী তাঁকে নিয়ে যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা রোগিকে সুস্থ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। পেটে পুনরায় কোলস্টোমি অপারেশন করে কৃত্রিমভাবে মলত্যাগের ব্যবস্থা করেন তারা। সেখানকার ডাক্তাররা জানান, মিরাকে ভুল অপারেশন করে ভুল চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে ২০২২ সালের ১৫ জুলাই সকালে মিরার মৃত্যু হয়। এবিষয়ে শাহীন আলী তখন থানায় অভিযোগ দিতে চাইলে ডা: সাইদুজ্জামান বিষয়টি জানতে পারে এবং শাহিনকে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিরার অপারেশন করা চিকিৎসক ডা. সাইদুজ্জামান (উপল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে ভিজিটিং কার্ডে যে পরিচয় তুলে ধরেছেন তা সঠিক নয়। মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন তিনি। মূলত মাষ্টার্স অব সার্জারী ‘এমএস ফেজ-এ’ ই পাশ করেনি উপল। অথচ তিনি জেনারেল ও ল্যাপোরোস্কোপিক সার্জন পরিচয় দিয়ে এ অপারেশন করেছেন।
এদিকে সিলেট মেডিকলেজের আবাসিক সার্জন ডা. আদনান জানিয়েছেন ডা. সাইদুজ্জামান সিলেট মেডিকেল কলেজে এমএস কোর্সে থাকলেও তা পাশ করতে পারেননি। কোর্সে অংশ নিয়ে বারবার ফেল করে সিলেট থেকে কোর্স আউট হয়ে পড়ে। তিনি এফসিপিএস-এ পড়ার জন্য উত্তির্ণ না হলেও প্রতিবেদককে বলছে এফসিপিএস শেষ বর্ষে পড়েন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ- বিএসএমএমইউ এ ছাত্র হিসেবে থাকলে তিনি পরিচয় দেন সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে। তাছাড়া সিলেট মেডিকেল কলেজের আবাসিক সার্জন, রেজিস্ট্রার এবং বিভাগীয় প্রধান প্রত্যেকেই জানিয়েছেন ডা. সাইদুজ্জামান (উপল) নামে কেউ উক্ত মেডিকেলে চাকরি করে না। জানা যায়, সিলেটে থাকাকালে তিনি অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে আশেপাশের ক্লিনিকে অপারেশন করতেন।
মিরার মৃত্যুর ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ঐ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার জানান ডা: সাইদুজ্জামান ও তার স্ত্রী এনেস্থেসিস্ট ডা. নীলিমা আফরিন রাজশাহী ও এর আশেপাশের উপজেলায় এমন অনেক অপারেশন করেছেন। অনেক রোগী পরে রামেকে এসে চিকিৎসায় সুস্থ্য হয়েছে, অনেকে মারাও গেছে। অন্তত মিরার অপারেশনটা করা ডা: সাইদুজ্জমানের করা উচিত হয়নি। অভিযোগ আছে, ডা. সাইদুজ্জামান দালালের মাধ্যমে কুষ্টিয়ার মিরপুর, দৌলতপুর, ভেড়ামারা প্রভৃতি এলাকার মানহীন ক্লিনিকে অপারেশন করেন। সম্প্রতি ডা. সাইদুজ্জামান অপারেশনে এক রোগীর খাদ্যনালী ফুটো হয়। পরে অন্যত্র চিকিৎসা নিয়ে কোনরকমে বেঁচে যায় সেই রোগী।
মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল বলছে, ডিম্বাশয় (ওভারি) এর ক্যান্সার খুবই কম হয়। আর উপজেলা পর্যায়ে নিশ্চিত ডায়াগনসিস ছাড়া যক্ষা রোগিকে ক্যান্সার বানিয়ে এমন অস্ত্রোপচার (অপারেশন) ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।
বিএমডিসি এর সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মো: আনোয়ারুল হক ফারাজি এই জানান, এই ডাক্তারের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এসেছে তা সত্য হলে তাঁর বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন বাতিল হবে। এবিষয়ে প্রতিবেদকের কথা হয় ঈশ্বরদীর সেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক মো: উজ্জ্বল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে এটা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে এ দায় ক্লিনিকের নয়। যিনি অপারেশ করেছেন সেই চিকিৎসকের। রোগীর পরিস্থিতি বুঝে যেকোন অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তার, সেক্ষেত্রে আমার কোন দায় নেই।
ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হওয়া মিরা খাতুনের স্বামী শাহীন আলী সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে পাবনার ঈশ্বরদীর সেবা ক্লিনিক মালিক উজ্জল হোসেন ও ডা: সাইদুজ্জামানের বিচার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে অভিযোগ দায়ের করে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে ভিজিটিং কার্ডে ভুয়া পরিচয় তুলে ধরার অপরাধে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে অভিযোগ দেন শাহিন।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, ডা. উপলের বিএমডিসি রেজিষ্ট্রেশনের মেয়াদ গত ২০২০ সালের ১১ মে তারিখে শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ,যখন এই চিকিৎসক মিরা খাতুনের অপারেশন করে তখন তার বিএমডিসি রেজিষ্ট্রেশনও ছিল না।
অভিযোগে শাহিন আলী বলেন, আমি যখন সেবা ক্লিনিক থেকে স্ত্রীকে বাঁচাতে জোর করে বের করে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাই। এটা ডা. সাইদুজ্জামান জানতে পেরে আমাকে ফোন করে তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থ্যা নেয়ার চেষ্টা করলে মিরা সহ আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এভাবে তিনি অনেক রোগিকে আগেও মেরে ফেলেছেন, তাঁর পরিচিত অনেক উকিল, রাজনীতিবিদ ও ডাক্তার আছে, কেউ তাঁর কিছুই করতে পারবে না। এভাবে হুমকি দেন। পুরো ঘটনা তদন্ত করে ডা: সাইদুজ্জামান (উপল) ও সেবা ক্লিনিক মালিক মো: উজ্জল হোসেনকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি করেন শাহিন।
মো: শাহীন আলী আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, সেবা ক্লিনিক মালিক উজ্জল ও ডা. সাইফুজ্জামান এ বিষয়ে থানায় মামলা করা বা আইনগত কোন ব্যবস্থা যাতে না নেই সেজন্য তারা হুমকি-ধামকি দিয়েছে। ভয়ে আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি বেশকিছু দিন। তবে আমি কোর্টে মামলা করার জন্য ইতিমধ্যে উকিলের মাধ্যমে আবেদন করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি সহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ দাখিল করেছি। আমি আমার স্ত্রীর চিকিৎসার নামে হত্যার বিচার চাই।
এই অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডা. সাইদুজ্জামান (উপল) সকল অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, আমি ভিজিটিং কার্ডে ভুল তথ্য দেওয়ায় ক্ষমাপ্রার্থী। তাছাড়া, আমরা সকল প্রকার পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে অপারেশন করেছি, আমাদের কোন হয় ভুল হয় নাই।
এ বিষয়ে পাবনা সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী জানান এ ব্যাপারে পাবনা ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা : খায়রুল কবির কে প্রধান করে ৪ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্য হলেন ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা : এস.এ আসমা খান ও ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কনসালটেন্ট (অর্থপেডিক) ডা : আবু তালেব।
তদন্ত কমিটির প্রধান ডা: খায়রুল কবির জানান আমারা তদন্ত শুরু করেছি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না।