চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। করোনা মহামারিতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতি অনেকটা বিপর্যস্ত। তবে এই করোনা মহামারিতেও কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা এখনো বেশ ভালোভাবেই সচল রয়েছে। আর কৃষির বহুমুখীকরণের মাধ্যমেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা সম্ভব হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা বলেন, প্রচলিত কৃষি কাজের বাইরে অর্থাৎ ধান-পাট এসব চাষের বাইরে কৃষির বিভিন্ন উপখাত যেমন, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগীর খামার, পশু পালন, দুগ্ধ খামার, বছরব্যাপী সবজি ও ফলের চাষে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এতে যেমন বহু বেকারের কর্ম সংস্থান হয়েছে তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিও বেশ চাঙ্গা হয়েছে।

করোনা মহামারিতে অনেকে চাকরি হারিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে মাছ চাষ, হাস-মুরগীর খামার নয়তো গরুর খামার করে আবার স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এসময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী গ্রামে গিয়ে হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, পশু পালন এবং বাণিজ্যিকভাবে সবজি-ফলমূল চাষ করে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া গ্রামের মা-বোনরা অনেকে হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, ভেড়া পালন, টার্কি পালন, বাড়ির আঙ্গিনায় ফলমূল, শাক-সবজি ইত্যাদি চাষের মাধ্যমে আয় করে অর্থনীতিতে নীরব অবদান রাখছেন। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করতে হলে কৃষির বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকিকরণের বিকল্প নেই। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত। কৃষিতে বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকিকরণের মাধ্যমে মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৮০ ভাগকে নিয়োজিত করে দেশে কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব।

সিপিডির সিনিয়র ফেলো বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, করোনাকালে গ্রামীণ অর্থনীতি বিশেষ করে কৃষি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। গতানুগতিক ধারার বাইরে আজ কৃষি নির্ভর আরও বহু উপখাতের বিকাশ ঘটেছে। এগুলো অনেকটা শিল্পখাতে রূপ নিয়েছে। যেমন হাঁস-মুরগীর খামার বা পোল্ট্রি শিল্প, ডেইরী শিল্প, মৎস্য চাষ ইত্যাদি। অনেক বেকার তরুণ এসব খাতে সম্পৃক্ত হয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখছে। তবে এখাতে বেকার তরুণদের আরও সম্পৃক্ত করতে সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। কৃষিখাতে প্রণোদনার ঋণ প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছানো হলে কৃষিভিত্তিক এসব শিল্পখাতের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। আর তাতে প্রচুর বেকারের কর্মসংস্থান হবে এবং কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে দেশও অর্থনীতিতে স্বনির্ভর হবে।

মৎস্য চাষে বাংলাদেশ স্বর্ণালী অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। মাছের উৎপাদনে বিশ্বে মধ্যে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। স্বাদুপানির মাছে বাংলাদেশ তার তৃতীয় স্থানটি ধরে রেখে উৎপাদন বাড়ানোর হারে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। চাষের মাছে দেশ গত ছয় বছরের মতোই পঞ্চম হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) মৎস্যসম্পদের অবদান এখন ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের ৫৬ শতাংশ মাছ আসছে পুকুর থেকে। পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে মোট উৎপাদন বেড়েছে ছয়গুণ। মাছ চাষ ও ব্যবসায় প্রায় দুই কোটি মানুষ যুক্ত আছেন। দেশের মোট রফতানি আয়ের ১.৩৯ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। এ খাতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.১০ শতাংশ। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনের হার মূলত বেড়েছে ইলিশের সৌজন্যে। গত এক যুগে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে জাতীয় মাছটির উৎপাদন এখন পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়েছে। ইলিশে এ দেশ বিশ্বে এক নম্বর। মোট ইলিশের ৮০ শতাংশই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বিশেষজ্ঞরা আরও কৃতিত্ব দিচ্ছেন, দেশের বিজ্ঞানীদের দেশি মাছের চাষোপযোগী উন্নত জাত উদ্ভাবনকে। এফএও এবং ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) একাধিক প্রতিবেদনও বলছে, বাংলাদেশে পুকুরে মাছ চাষে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক বেকারের কর্মসংস্থানও হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নদী ও জলাশয়ে মাছের চাষ তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। দেশের বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলো এখন চাষ হচ্ছে। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত রুই, কাতলা, কই, তেলাপিয়া, কালবাউশ ও সরপুঁটির উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। দেশের পুকুরে যত মাছ চাষ হচ্ছে, তার অর্ধেকেরও বেশি এসব জাতের। বিজ্ঞানীরা দেশের বিলুপ্তপ্রায় ২২টি প্রজাতির মাছের চাষপদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছেন। সে তালিকায় টেংরা, পাবদা ও মলার মতো পুষ্টিকর মাছগুলো রয়েছে।

মৎস্যখাতের মতো পোলট্রিশিল্পও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচনে এ খাতের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির উপখাত হিসেবে পোলট্রি খাতের অবদান ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ২০ লাখেরও বেশি মানুষের স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে রয়েছে। যদি পরোক্ষ অংশটি যোগ করা হয় তবে এই অঙ্কটি দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার ৪৫ শতাংশ এখন পোলট্রি খাতনির্ভর এবং বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে আত্মকর্মসংস্থান তথা উৎপাদন আয় বাড়ানোর আরও সুযোগ রয়েছে। পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত সংগঠনের নেতারা মনে করেন দেশে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আবার শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে ১ শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমি যা এক বিস্ময়কর চিত্র। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা তথা পুষ্টিনিরাপত্তায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এই খাতটি।

কৃষির উপখাত হিসাবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো গবাদি পশু খাত। কয়েক বছর আগেও দেশের গোশতের চাহিদার বড় অংশ মিটত প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে গুরু আমদানি করে। বর্তমানে সে চিত্র আর নেই। এখন দেশের গবাদি পশুতেই গোশতের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ করে দেয়। এতেই বাজারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে গবাদিপশুর লালনপালন ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। দেশে প্রতিবছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদিপশুর খামার বাড়তে শুরু করে। তিন বছরে দেশে গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ। ফলে গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে গবাদিপশু পালন ক্রমেই বাড়ছে। গবাদিপশু পালনে দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের মাংসের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। গবাদিপশুর খামার বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতিকে বদলে দিচ্ছে।

ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ সফলতার বিশ্বের এখন উদাহরণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ নাম। ২০ বছর আগে এই দেশের প্রধান ফল ছিল আম আর কাঁঠাল। এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। আগে হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, গত ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন, তরমুজ ইত্যাদি। আগে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ হতো না। এখন বাণিজ্যিকভাবে অনেকে পেয়ারা, কলা, কুল, পেপে, লেবু এসব চাষ করছেন। এ ছাড়া আম কাঁঠালও এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে।

বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে ৯৪তম। আর জনসংখ্যায় অষ্টম। সবচেয়ে কম জমি, আর বেশি মানুষের এই দেশ ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে চলতি বছর ১ কোটি ২১ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। ১০ বছর আগের তুলনায় উৎপাদন ১৮ লাখ টন বেড়েছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ ইনকিলাবকে বলেন, ফল চাষে বাংলাদেশে রীতিমতো একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা, পুকুর পাড় ও সড়কের পাশে ফলের গাছ রোপণের প্রবণতা বেড়েছে। এতে বাংলাদেশ এখন খাদ্যনিরাপত্তায় বিশ্বের অন্যতম সফল দেশ। হয়েছে এবং বিশ্বক্ষুধা সূচকে তিন বছরে ছয় ধাপ এগিয়েছে; তার পেছনে ধান, সবজি ও মাছের পাশাপাশি ফলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে জানান তিনি।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.