হিমুরা হাঁটবে, রুপারা অফুরান অপেক্ষায় ডুববে, লিখবে কত না চিঠি! – জাহিদ হাসান নিশান

0

হুমায়ূন আহমেদ একটি অধ্যায়ের নাম। তিনি বাংলা ভাষার অধিক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, এতে সন্দেহ নেই। তবে আমি তাকে বিবেচনা করতে চাই বিচিত্নর জীবনের সফল রূপকার হিসেবে। কেননা, তার উপন্যাস পাঠের ভেতর দিয়ে প্রকারান্তরে সে-পথেই নিজেকে পরিচালনা করতে অনুপ্রাণিত হই, মূলত যা লেখকের অভীপ্সা। খেলিয়ে খেলিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন পাঠককে তিনি । সক্ষ্মবোধের অতলান্ত নিবিড়ভাবে স্পর্শ করতে চেষ্টা করছেন। পাঠমুখী করতে বোর হয়ে যাওয়া পাঠককে তিনি অবলম্বন করেছেন এই কৌশলে! আবার হতে পারে এটা, ভিন্নতর কোনো নিরীক্ষা।জীবন ও সমাজদর্শন যেখানে নিহিত রয়েছে ব্যাপকভাবে।

যখন পাঠ করি, ‘নন্দিত নরকে’ , তখন হারিয়ে যাই বইয়ের প্রতিটা পাতায়। আবার শঙ্খনীল কারাগার,লীলাবতী, হিমু, দূরে কোথাও কিংবা হিমু’র ভেতর ডুব দিয়েছি, তখন অন্য এক আমাকে চিনতে পারি। ততদিনে পরিণত হয়েছি নিজেও। তাঁর নাটক দেখেছি, হুমড়ি খেয়ে পড়ছি প্রেক্ষাগৃহে ।

আজও জ্যোৎস্নাময় রাতে একাকী গেয়ে উঠি ‘চাঁদনি পসর রাইতে’ পথে কিংবা দলগত আড্ডায় এখনো অবলীলায় কণ্ঠে তুলে নিচ্ছি- ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়া গো করো তোমার মনে যাহা লয়’,মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ’ যদি মন কাঁদে’ বরষার প্রথম দিনে’ অবচেতনে নয় এসব, করছি বুঝে-শুনে।

চলাফেরায় আসছে পরিবর্তনও,আয়োজনে কিংবা পাঠে । নিজের অনুভবের জায়গাটিতে পরিবর্তন টের পাচ্ছি। হয়তো, মানসিক বিবিধ পরিবর্তনের অর্থ দাঁড়ায়, হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অলিখিত দর্শন। যা চেতনে-অবচেতনে প্রভাবিত করে, উৎসাহিত করে। উদাসীন হাওয়ায় ভেসে ভেসে জীবনকে সর্বৈব উপলব্ধি করার মন্ত্রণা জোগায়।

আসলেকোনো উপলব্ধিই চূড়ান্ত রূপ পায় না, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে। অকাঠ্য যুক্তি হলো এর পেছনে, সাধারণের কাছে ব্যক্তি হুমায়ূন যেমন রহস্যময়, গভীর রহস্যের আকর তেমনি তার সাহিত্যকর্মও। তাঁর উপন্যাসের সরল বাক্যের মতো মোটেও সহজতর ব্যাপার নয় তাকে আবিষ্কার করাটা।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়ে, সৃষ্ট চরিত্র অনুসরণ করে দলবেঁধে কিংবা একা একা পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো নিছক জাদুবাস্তবতা ছাড়া অন্যকিছু নয়। তবে কি তিনি হ্যামেলিয়নের বংশীওয়ালা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন? হয়তো, না-হলে তিনি সহজ কথার জাদুতে কিভাবে পাঠককে আশ্চর্য এক বাস্তবতার মুখোমুখি নিয়ে যেতেন! যেখানে দাঁড়িয়ে জীবনের সঙ্কট, অনুভূতি, বেদনা তলিয়ে যায়; যে বেদনার পরিচর্যা করলে মানুষ আরো বেশি মানুষ হয়ে ওঠে। তিনি নানাভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন এমন এক সম্মোহনের জীবন, যেখানে নানাভাবে ফুটে আছে বহুরঙের জীবন। তাই তিনি বলতে পারেন- ‘জীবনটা আসলেই অনেক সুন্দর! এতো বেশি সুন্দর যে, মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।’ প্রকৃত প্রস্তাবে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ একই সুতোই বেঁধে মূলত জীবনেরই জয়গান গেয়েছেন। যে জীবানুভ‚তির ছোট্ট এক টুকরো ‘শ্যামলছায়া’ আমি। শরৎ কিংবা হেমন্তের ধবল জ্যোৎস্নায় স্নান সেরে নিঃশব্দে হিমু হতে চেয়েছি বহুবার। এই পরিণত জীবনে এসেও হিমু হওয়ার প্রবল বাসনায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ পেরিয়ে ভেসে যাই অলক্ষে, জলশ্রীতে। সাক্ষী রেখে নিঃসঙ্গ বটগাছ কিংবা ভাবনার পোতাশ্রয়।

হলো না ভবঘুরে জীবনের ইতি। হলুদ পাঞ্জাবিতে যুক্ত হলো না পকেটও। তবুও হিমুস্রষ্টা হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে তাঁরই রচে যাওয়া অজানা অদেখা সহস্র হিমুর মধ্যে।

হিমুরা হাঁটবে, আর তাদের জন্য দেখা-অদেখা রুপারা অফুরান অপেক্ষায় ডুববে, লিখবে কত না চিঠি!

—- জাহিদ হাসান নিশান।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.