মোদির এবারের বাংলাদেশ সফর এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে । তিমির চক্রবর্ত্তী

0

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এবারের বাংলাদেশ সফর এক ঐতিহাসিক। ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু স্বাধীনতার আগে থেকেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত পাশে না থাকলে এদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা একথায় অসম্ভব। ইন্দিরা থেকে শেখ মুজিব, আর মোদি থেকে শেখ হাসিনা -দুই দেশের সস্পর্ক যেন আরো উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০তম বছর উদযাপন করতে আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সফরের বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, মোদিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগামী ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় শীর্ষ বৈঠক করবেন। বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০২১ সালকে ঐতিহাসিক হিসেবে বর্ণনা করেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকী এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হবে এ বছর। তাই মোদির এই সফরে দেশে এক উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।

মোদি সরকার ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের অসমাপ্ত কাজ যেন সমাপ্ত করতে একেবারে যোগ্য প্রধানমন্ত্রী। এর প্রমান মেলে বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘ ৬৮ বছরের সীমান্ত সমস্যার সমাধান, সমূদ্র সীমানা নিস্পত্তি, সীমান্ত হাট এবং একে একে দুই দেশের অভিন্ন সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুলে দিয়ে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে ভারতের কাছে বাংলাদেশের অনেক কিছুই চাওয়ার আছে আর ভারতেরও এদেশের কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আশা করতেই পারে। তাই ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে স্মরণ করে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মুজিবনগর থেকে নদিয়ার ঐতিহাসিক সড়কের নামকরণ ‘স্বাধীনতা সড়ক’ করতে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য ভারতীয় পক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

এবারের ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে বলা যায় যে প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই যেভাবে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে বিজেপির কোনো ক্ষুদ্র রাজনীতি তার সঙ্গে যুক্ত নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সংঘাত হতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে বাদ সাধাতেই চুক্তিটি সম্পাদন করতে নরেন্দ্র মোদি বা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব পারেননি। এটা যেমন সত্য। আবার এটাও সত্য যে নরেন্দ্র মোদি এবারের সফরে গিয়েও এই কথাটা জানাবেন, যেটা এরই মধ্যে জয়শঙ্করের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছে, যে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনা এখনো না হলেও তিস্তা নদীর চুক্তি বিষয়ে ভারতের যে কমিটমেন্ট, সেই কমিটমেন্ট থেকে ভারত সরে আসেনি। তাদের অবস্থানগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। চুক্তি যাতে হয়, আশা করা যায় তার জন্য সব রকমের চেষ্টা নতুন উদ্যোগে নরেন্দ্র মোদি শুরু করবেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের কী ফল হয় তা কেউ জানে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফল যা-ই হোক না কেন এবং যে দল আসুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন পরবর্তী সময়ে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা একেবারেই অসম্ভব হবে না।

তবে এবারের সফরের আগে মনে রাখতে হবে, ভারত-বাংলাদেশ গত বছর ডিসেম্বর মাসে একটা ভার্চুয়াল সামিট করেছিল। সেখানে গত সেপ্টেম্বরে জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠক করেছিলেন। পররাষ্ট্রসচিবরা এবং তার সঙ্গে বিদ্যুৎসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশপ্রধান, বিএসএফ, বাংলাদেশের বিজিবি এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের মধ্যে একটা আলাপ-আলোচনা ও বৈঠক হয়েছিল।
শেখ হাসিনার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে জয়শঙ্কর বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে। সেটা দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ককে, ে নেতৃত্বকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তার প্রতিফলন হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে বা মুজিববর্ষে একদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর, আরেক দিকে আমাদের দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেরও ৫০ বছর।

এই উদযাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী গেলেও এই উদযাপন সামনে রেখে সুদূর-অতীতের স্মৃতিচারণা নয়, আগামী দিনে কিভাবে এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সব রকমভাবে দুই দেশের মধ্যে এবার আলাপ-আলোচনা হবে। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর এবার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জয়শঙ্কর ঢাকায় এসে বলেছেন, করোনা কূটনীতির ক্ষেত্রেও প্রতিষেধক দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এই প্রতিষেধক দেওয়ার বিষয়টা বন্ধ হচ্ছে না। তার একটা পথনির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। সেটা বাংলাদেশকে পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশ সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া থেকে প্রতিষেধক কিনছে। সেটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সেগুলোকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ফ্রি অব কস্ট। সেটা অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে শেখ হাসিনা গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দিচ্ছেন, সে কথা জয়শঙ্কর স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তিস্তা ছাড়াও অন্য নদীগুলোর ক্ষেত্রেও ওয়াটার রিসোর্স সেক্রেটারিরা আলাপ-আলোচনা করবেন এবং আলাপ-আলোচনা করেছেন। কিছুদিন আগে দিল্লিতেও আলাপ-আলোচনা হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এখন এক উৎসবের পরিবেশ। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনও একটি অনুষ্ঠান করে, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিববর্ষ এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের অর্ধশতবর্ষ পালনের ব্যবস্থা করেছেন। আলোচনাসভা এবং নানা রকম সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ দুই দেশেই হচ্ছে এবং আরো হবে।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে একটা কথাই বলা যায়, করোনা-উত্তর কূটনীতি নিয়ে এবং প্রতিষেধকের বণ্টন নিয়ে গোটা পৃথিবী ব্যস্ত। যখন চীন ও ভারতের মধ্যে আপাতত একটা সংঘর্ষ-বিরতি দেখা যাচ্ছে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেও একটা সংঘর্ষ-বিরতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; তবু ভারত কিন্তু চীন-পাকিস্তান অক্ষ নিয়ে খুব সতর্ক। বাংলাদেশের জিওস্ট্র্যাটেজিক পজিশন সম্পর্কে এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদি বিশেষভাবে ওয়াকিফহাল। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে ভারত চাইছে, উপমহাদেশে শান্তি আসুক। শেখ হাসিনাও চাইছেন দুই দেশের মধ্যে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে। শুধু তা-ই নয়, এই উপমহাদেশে শান্তির পরিবেশ রচনার চেষ্টাও চলছে। কিন্তু গোটা উপমহাদেশের পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশ ও ভারতকে পাশাপাশি থাকতে হবে। সেটা ভারত যে গভীরভাবে চাইছে, সেই বার্তাটা দেওয়াই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই আসন্ন সফরের সব থেকে বড় লক্ষ্য।

আর এখন ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক এক নুতন মাইলফলক স্পর্শ করেছে যেমন-ব্যবসা বানিজ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে। এর প্রমান পাওয়া যায় গত মঙ্গলবার ২ মার্চ ফেনী নদীর উপর নির্মিত ১.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মত্রৈ সেতু দুই দেশকে এক করে এক মেলবন্ধণ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে খাগড়াছড়ির রামগড়ে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত সেতু রামগড়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম শহরকে যুক্ত করেছে। দুই অঞ্চলের বানিজ্যের নুতন মাত্রা যোগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারতকে কানেক্টিভিটি (সংযুক্তি) দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে। আমরা এমন একটি অঞ্চলে আছি, যেখানে কানেক্টিভিটি চালুর বিষয়ে রক্ষণশীল ছিল এবং যেখানে সম্ভাবনার চেয়ে আন্ত-আঞ্চলিক বাণিজ্য অনেক কম। আমি বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাগুলো ব্যবসার ক্ষেত্রে ভৌত বাধা হওয়া উচিত নয়।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, শুধু চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর নয়, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও ত্রিপুরাবাসী ব্যবহার করতে পারবে।
অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, কানেক্টিভিটি শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বই জোরদার করছে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি করছে। পুরো ত্রিপুরা অঞ্চলকে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে বাণিজ্য করিডর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এক টুইট বার্তায় মোদি জানিয়েছেন, মৈত্রী সেতু একটি যুগান্তকারী প্রকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, যা ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের উন্নতি করবে। সবমিলিয়ে মোদির এই সফর এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। একথা অনস্বীকার্য। যদিও ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন মোদির এই সফরে কোন চুক্তি হবে না । তাঁর এই সফর শুধুৃই উৎসব। তথাপিও এই সফর ৭১ এর ঘটনা প্রবাহ থেকে শুরু করে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, মুজিব জন্মশতবার্ষিকী এবং দুই দেশের সম্পর্কের এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত।

তিমির চক্রবর্ত্তী : কলাম লেখক ।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.