বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন স্বাধীনতা, শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক মুক্তি । মো. নূরুল আমিন

0

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কৃষক তার লাঙ্গল রেখে, শ্রমিক হাতুড়ি রেখে, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী তাদের কলম রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ জীবন, ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে জাতি অর্জন করে মহান বিজয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ছাপ্পান্ন জন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালিরা করতে চায়নি। তারা চেয়েছে বাংলার সঙ্গে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক, তাতে আপত্তি নেই; কিন্তু বাঙালির এ উদারতাটাই তারা দুর্বলতা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে’ (পৃষ্ঠা ১৯৭, ১৯৮)।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দিবসে’ ভোরবেলা পিকেটিং করা অবস্থায় ইডেন বিল্ডিংয়ের দরজা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৫ মার্চ তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৬ মার্চ সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সাধারণ ছাত্র সভায় তিনি সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনকে গতিশীল করতে তিনি সারা দেশে সভা-সমাবেশ করেন।

১৯৪৯ সালে ডিসেম্বরে আবার গ্রেফতার হয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ পর্যন্ত তিনি ৭৮৯ দিন কারাগারে ছিলেন। কিন্তু কারাগারে থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘খবর পেয়েছি আমাকে শিগ্গির আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকে এলো। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে।

আমি আরও বললাম, আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব’ (পৃষ্ঠা ১৯৭)। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজ মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিল। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ অনেকে রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করে।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘এদিকে বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করেছে, তাদের ওপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতেও অবিচার চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে রাজধানী হওয়াতে বাঙালিরা সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হতে শুরু করেছে’ (পৃষ্ঠা ১৯৮)। এ অবস্থা বুঝতে পেরে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলগুলোর জাতীয় সম্মেলন বিষয় নির্বাচন কমিটিতে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন।

ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরি করতে তিনি সারা দেশে ঘুরেছেন। এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্য তা জনসাধারণকে বোঝাতে সক্ষম হন; ফলে ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ব্যাপক হওয়ায় জনগণ ছয় দফাকে বাঁচার দাবি হিসাবে গ্রহণ করে। ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়।

পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে ১নং আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে, যাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলা হয়। সেনানিবাসে আটক রেখে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরু করে। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ছয় দফাসহ ছাত্রদের ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন পরিণত হয় গণআন্দোলনে। যার ফলে পাকিস্তান সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে প্রিয়নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

আসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখাগরিষ্ঠতা লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়লাভ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

৩ জানুয়ারি রেসকোর্সে জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৩ মার্চ হরতাল পালিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়াকে আহ্বান জানান।

এরপর আসে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। এদিন বঙ্গবন্ধু জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক হয়। ২৪ মার্চ পর্যন্ত মুজিব ইয়াহিয়া ভুট্টো বৈঠক চলে। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হলে রাতে বাঙালির ওপর পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে অবতরণ করলে বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। ওইদিন তিনি বলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’ ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের পর ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করলে দেশের উন্নয়ন আবার থমকে দাঁড়ায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসনে থাকার পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশে আসেন। তিনি শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৯৭-২০০২) গ্রহণ করে বাস্তবায়ন শুরু করেন।

তিনি পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেন, যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করেন, দারিদ্র্যবিমোচন ও খাদ্যে নির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, যেমন-দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে দারিদ্র্যবিমোচনে বিরাট সাফল্য অর্জন করেন।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, এমডিজি ও প্রথম পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করেন। ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে দেশকে এগিয়ে নিতে সুযোগ পান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দেশের দারিদ্র্য, ক্ষুধাদূরীকরণ, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা ও ডিজিটালাইজেশনকে অগ্রাধিকার প্রদান করেন।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩,২০,০৭২টি পরিবারকে আশ্রয়ণের সুযোগ করে দিয়েছেন। এমনকি মুজিববর্ষের উপহার হিসাবে ৬৬,১৮৯ পরিবারকে একক ঘর করে দিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবা দিতে মানুষের দোরগোড়ায় ১৪,৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করে দিয়েছেন। ৩ কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে মেধাবৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান করে, ৮৭ লাখ মানুষকে বিভিন্ন ভাতা দিয়ে, ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা মূল্যের চাল দিয়ে, কৃষি খাতে কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান করে, করোনা মহামারিকালে ১,২১,০০০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে দেশের অর্থনীতিতে ও দারিদ্র্য নিরসনে বিরাট ভূমিকা রাখেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। পদ্মা বহুমুখী সেতু যার কাজ ইতোমধ্যে ৯১ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের মার্চে সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াত শুরু হবে। এর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্প, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চলছে অর্থাৎ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ঘোষণা দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম অর্থনীতির দেশ। দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩১ সালে বাংলাদেশে অতিদরিদ্র বলতে কেউ থাকবে না। বাংলাদেশ হবে উচ্চ-মধ্যমআয়ের দেশ এবং দেশটি হবে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়।

লেখক : সিনিয়র সচিব (পিআরএল ভোগরত), পরিকল্পনা বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.