প্রসঙ্গ : ছদ্মনাম কবি গুরুর ছদ্ম নাম । শফি ইসলাম

0

নামের রহস্য লেখকের গুরুত্ব বাড়ায়, তবে লেখার গুরুত্ব যদি কিছু থাকে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁর ছদ্ম নাম দিয়ে আসল নামকে আড়াল করে রাখেননি। নামগুলি অনেক পাঠকেরই জানা। বানী বিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে তিনি একটা লেখাই লিখেছিলেন। স্বভাবত এগুলি কবির সাময়িক খেয়াল প্রথমতঃ তিনি যে ছদ্ম নাম গ্রহণ করেন সেটা হলো ছিল শুন্য ভট্টাচার্য। তখন তাঁর বয়স খুবই কম। বিলাতের একজোড়া তরুণীর কথা ভেবে এই নামে তিনি একটি কবিতা লেখেন। তিনি বলেছেন দু’জনেই আমায় ভালবাসতো, কিন্তু সে কথা বিশ্বাস করার মতো মরালকারেজ ছিল না আমার। অবশ্য স্পষ্ট করে বলা যায় না যে তিনি ঐ বিদেশী মেয়েদের কথা ভেবেই কবিতা লিখেছিলেন, তবে ধারণা করা হয়। কিন্তু ঐ একবারই ঐ নাম ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কারণটি কি ছিল অল্প বয়সে সাহসের অভাব?

ভানু সিংহ নামটা যদিও কবির ছদ্মনাম কিন্তু ওটা এখন ছদ্মনাম বলা যায় না; এতই পরিচিত ছিল এই নাম। এই নামটা অনেকটা মজা করার জন্যই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এই নামে তিনি কবিতাই লেখেননি তিনি চিঠিও লিখেছিলেন। অর্থাৎ, এটি আর তখন ছদ্মনাম থাকেনি তাঁর আরেকটি ডাক নাম হয়ে উঠেছিল। বানী বিনোদ নামটি একটি জরুরি কারণে নিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে লেখা একটি ইংরেজী বই পড়ে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সেই বই সম্পর্কে পরে যে নিবন্ধটি তিনি লেখেন সেটার জন্য এই ছদ্মনামটি নিয়েছিলেন।

তবে রবীন্দ্রনাথের আসল ছদ্মনাম ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর রচনার ভিতরেই। সম্ভবত অনেক লেখকই এমন করে থাকেন। এই সব নাম আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনি ছদ্মনাম বলে ঘোষণা করেননি কিন্তু পাঠকরা এদের সহজেই চিনতে পারেন। এগুলি তাই ছদ্মবেশ হলেও এগুলিই তাঁর আসল বেশ হয়ে উঠেছে। বিচার করে দেখতে গেলে এইসব নাম যথেষ্ঠ কৌতুহলোদ্দীপক। কারণ এই সবের মধ্যে কবির জীবন-যাপন এবং জীবন-দর্শন বিকশিত হয়ে উঠেছে। কবি নিজে যেমন ছিলেন, বা যেমন হতে চাচ্ছিলের, সেই সবের একটি ইতিহাস এই সব চরিত্রের মধ্যে ধরা পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনী লিখতে গেলে এই নাম গুলির জীবনীও লিখতে হয়। কবি কি ছিলেন, কি হতে চেয়েছিলেন, সেটা এই সব নামের কাজ কর্ম থেকেই বের হয়ে এসেছে।

গোরা উপন্যাসটি কবির আত্মজীবনীর অংশ বলা যেতে পারে, একথা অনেকেই শিকার করেন। গোরা প্রথমদিকে যে ধরনের গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন ছিল সে ধরনের সীমাবদ্ধতা এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের নিজেরও ছিল। শান্তি নিকেতনে বেশ কয়েক বৎসর ব্রাক্ষ্মণ ও অব্রাক্ষ্মণ ছেলেরা পাশাপাশি খেতে বসতো না। ব্রাক্ষ্মন ছাত্ররা ব্রাক্ষ্মন শিক্ষককে প্রণাম করতো, অব্রাক্ষ্মন শিক্ষককে নমস্কার করতো। ক্রমশঃ এই সবের উপরে উঠেছিলেন বলেই তো রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে পেরেছেন।

গোরার গোঁড়ামি যখন উপন্যাসে ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেল, তখন রবীন্দ্রনাথই গোরার কন্ঠে কথা বললেন, “আমি যা হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ তাই হয়েছিল” “ঘরে বাইরে” উপন্যাসে সন্দীপ হিন্দুত্বের সংকীর্নতাকে মূলধন করে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে নিখিলেশ তার উদার এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সমাজকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। বয়কটের নামে বিলেতি কাপড় পোড়ানোয় যে বিলেতের ক্ষতি হয় না, হয় এদেশী ব্যবসায়ীদের একথা রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, নিখিলেশও তেমনি বলেছে। রবীন্দ্রনাথ একদিন সন্দীপ হয়েছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে নিখিলেশ হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। এ দু’টিও রবীন্দ্রনাথের নাম।

“চতুরঙ্গের” জ্যাঠা মশাই কি রবীন্দ্রনাথ? “ঠাকুঁদা” এই নামটি রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটকেই আছে। “ডাকঘর” নাটকে ঠাকুঁদা যখন বলেন “চুপ করো অবিশ্বাসী কথা কোয়োনা” অথবা “অচলায়তন” নাটকে দাদা ঠাকুর যখন বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন কে তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে খেলা করতে চেলেছিলেন? “ফাল্গুনী” নাটকের বুড়োকে খুঁজতে বের হয়ে ছেলে দল তাদের সর্দারকেই পেয়ে গেল। কারণ বুড়ো তো কোথাও নেই। অন্ততঃ রবীন্দ্রনাথ তো বুড়ো হননি, তিনি “বারে বারেই প্রথম, ফিরে ফিরেই প্রথম। “বাউল যাকে নিয়ে গান গায়, “তোমায় নতুন করে পাব বলেই হারায় ক্ষনে ক্ষন/ ও মোর চিরকালের ধন”। “কালের যাত্রা” নাটকে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ কোন নাম গ্রহণ করেননি, সরাসরি “কবি” নামই রেখেছেন। সেই কবির কথায়, “আমরা যানি ছন্দ, জানি একগোঁফা হলেই তাল কাটে”। “শেষের কবিতা” উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ একবার অনাগত যুগের নিবারন চক্রবর্তী নাম নিয়েও নিজেকে পরাজিত করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত নিবারনকে নিয়ে এসেছেন রবি ঠাকুরের ছায়ায়। “চিঠি পত্রে” যষ্ঠীচরন যদিও নবীন কিশোরের সঙ্গে তর্ক করেছেন, এবং নবীন কিশোর সে তর্কে প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.