কাঁচা লঙ্কার পাঁচালি । এবাদত আলী
নামের পরিচিতি থাকলে কামের বা কাজের গুনাগুণ মেলে। তা বুঝতে পারলাম যখন ভারত ভ্রমণে যাবার জন্য পাসপোর্ট অফিসে গেলাম। বলতে গেলে আমি যেখানেই যাই আমার সুহৃদ দৈনিক সিনসা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সৈয়দ সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে যাই। বিশেষ করে অফিস আদালতে গেলে ওকে সঙ্গে নিতেই হয়। কারণ নিজের পরিচয় তো আর নিজে অতো দেওয়া যায়না। পাসপোর্ট অফিসের বারান্দায় পা রাখতেই বেশ কয়েকজন ছুটে এসে সালাম জানালেন যেন কত দিনের চেনা। সালামের উত্তর দিয়ে সোজা ভেতরে এডি সাহেবের কামরায় প্রবেশ করতেই তারা হতাশ হয়ে পিছু ছাড়লো। ওনারা নাকি পাসপোর্ট অফিসের দালাল।
সৈয়দ সাইফুল নিজের ও আমার পরিচয় দিলে এবং আমাদের পাসপোর্ট দরকার জানালে তিনি সাগ্রহে কলিং বেল টিপে কয়েকজন ষ্টাফকে ডেকে পাঠালেন। তারপর ফরম পুরণ থেকে আনুসঙ্গিক কাজ ইথারের গতিতে হয়ে গেল। এর পর ছবি উঠার পালা। ছবি ঘরে লম্বা লাইন। সকলকে পিছনে ফেলে আমাদের ছবি তুলে বিদায় করা হলো। সরকারি ফি ছাড়া একটি কানাকড়ি কোথাও দিতে হলোনা। দিন কয়েক পর মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ পাওয়া গেল পাসপোর্ট ও মিল্ল। এবার ভিসার পালা।
রাজশাহী হতে ভিসা নিতে হয়। এবারে দৈনিক সিনসা পত্রিকার সম্পাদক এসএম মাহবুব আলম ও গেলেন আমাদের সঙ্গে। ভিসা অফিসের কাজ শেষে সৈয়দ সাইফুলের প্রস্তাব মতে ফুটপাতের একটি দোকানে গিয়ে মাসকলাইয়ের রুটি আর কাঁচা মরিচ ভর্তা খেলাম। আহা কাাঁচা মরিচের যে কি স্বাদ তা বলে বুঝানো যাবেনা। তাই বলে আজকাল ফেস বুকে টিকটক বানাতে গিয়ে ঘাস খেয়ে, গাছের পাতা খেয়ে এবং মানকচু খেয়ে আহা কি স্বাদ একথা বলা নয়। সত্যি সত্যিই তা ছিলো স্বাদের। কাঁচা মরিচের সঙ্গে সম্ভবত সরিষা বাাঁটা আর ভিনেগার। ফুটপাতের বাবুর্চি এক মহিলা। তার স্বামী তার সাহায্যকারি। আমাদের মত খরিদ্দার অনেক। আমরা আগেভাগে বেঞ্চে বসেছিলাম বলে আমাদের ছিলো অগ্রাধিকার। বাবুর্চি রুটি তৈরি করছে তার স্বামী কাঁচা মরিচের ভর্তাসহ আমাদের মত খরিদ্দারের হাতে তুলে দিচ্ছে। আমরা টিকটকার হলে নির্ঘাত একটি ভিডিও ভাইরাল হতো আহা কাঁচা মরিচের কি যে স্বাদ।
কাঁচামরিচের স্বাদ ও গুনাগুণ শুধু আজকে নয়। সুদুর অতিতেও ছিলো। বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র হতে জানা যায় প্রায় সাত হাজার পাাঁচশ বছর আগে থেকেই আমেরিকার আদিবাসীরা মরিচ ব্যবহার করে আসছে। ইকুয়েডরের দক্ষিন পশ্চিামাংশে পুরাতাত্বিকেরা ছয় হাজার বছর আগে মরিচ চাষের প্রমাণ পেয়েছেন। দিয়াগোা আলভারেজ চানকা নামের একজন চিকিৎসক কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযানের সময় পশ্চিম ভারতীয় দ্বিপপুঞ্জ হতে মরিচ স্পেনে নিয়ে আসেন। তিনি ১৪৯৪ সালে মরিচের ঔষধি গুনাগুণ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন। স্পেনীয় ব্যবসায়ীরা মেক্সিকো থেকে মরিচ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান। প্রথমে ফিলিপাইন এবং তার পর ভারতবর্ষ,শ্রীলঙ্কা, চীন কোরিয়া ও জাপানে মরিচ বিস্তার লাভ করে। ঝাল ও স্বাদের জন্য অচিরেই এটি এশিয়ার বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় খাবারের অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হয়। শ্রীলঙ্কায় উৎপাদিত কাঁচা মরিচকে কাঁচা লঙ্কা বলা হয়ে থাকে।
কাঁচা লঙ্কার গুনাগুণ আরো মেলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকতা আক্রমণ করার আগে ১৭৫৬ সালে কাশিম বাজার কুঠি দখল করে নিয়েছিলেন এবং ইংরেজ সাহেবদেরকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ জেলখানায় রেখেছিলেন। সেই সাহেবদের মধ্যে বাংলার গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিং ও ছিলেন। সেসময় কাসিম বাজার কুঠির দায়িত্বে ছিলেন ভিনেট। তিনি ওয়ারেন হেষ্টিংকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে কোম্পানির সামান্য একজন কর্মচারি তাই দয়ালু নবাব হেস্টিংকে ছেড়ে দিলেন। পরে নবার জানতে পারেন যে হেস্টিং তার বিরুদ্ধে গভীর য়ড়যন্ত্র করছে তাই তাকে আবার জেলখানায় পুরবেন বলে ঘোষণা দেন।
১৭৫৩ সালে হেষ্টিং যখন ইংরেজ কোম্পানির চাকরি নিয়ে কাশিম বাজর আসেন তখন সেখানকার এক মহুরি কান্ত বাবু ছিলো তার ঘনিষ্টজন। তাই হেষ্টিং গোপনে কান্ত বাবুর বাড়ি গিয়ে আত্মগোপন করেন। কান্ত বাবু তাকে তার মুদি দোকানে লুকিয়ে রাখেন। সেখানে তাকে পান্তাভাত আর কাঁচা লঙ্কা এবং তার সাথে চিংড়ি মাছ খেতে দেওয়া হয়। সেই থেকে মানুষের মুখে মুখে তখন একটি ছড়া প্রচলিত ছিলো: “হেষ্টিং সিরাজ ভয়ে হয়ে মহা ভীত/কাশিম বাজারে গিয়ে হন উপনীত/কান্ত মুদি ছিলো তার পুর্ব পরিচিত। মুস্কিলে পড়িয়া কান্ত করে হায় হায়/ হেষ্টিংকে কি খেতে দিয়ে প্রাণ রাখা যায়/ ঘরে ছিলো কাঁচা লঙ্কা আর চিংড়ি মাছ।”
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পান্তা ভাত আর কাঁচা লঙ্কা খেতে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে তার নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর হাতের পান্তাভাত ও সঙ্গে চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবন স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন,-‘‘ ইসকুল থেকে ফিরে এলেই রবীর জন্য থাকে নতুন বৌঠানের আপন হাতের প্রসাদ। আর যেদিন চিংড়ি মাছের চচ্চড়ির সঙ্গে নতুন বৌঠান নিজে মেখে দেয় পান্তাভাত, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সেদিন আর কথা থাকেনা।’’
বিভুতিভুষণ বন্দোপাধ্যায় শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাঁচা লঙ্কা পছন্দ করতেন। পল্লী কবি জসিম উদ্দিনকে ছাত্রবস্থায় পান্তা আর কাঁচা মরিচ খেতে হয়েছে অভাব অনটনের কারণে।
বাঙালির জীবনে কাঁচামরিচ খাদ্য খানার এক বিশেষ উপাদান। গরীব কিংবা ধনীর রান্না ঘরে কাঁচা মরিচ চাইই। কিন্তু তাই বলে হঠাৎ করে কাাঁচা মরিচের দাম বেড়ে যাবার কারণ কি। পত্র-পত্রিকার খবর হতে জানা যায় ঢাকার বাজারে কোন কোন স্থানে এক কেজি কাঁচা মরিচের দাম এক হাজার থেকে বারোশ টাকা। কাঁচা মরিচ উৎপন্ন হয় গাঁও গেরামের কৃষকের জমিতে। বিক্রয় করতে গেলে কৃষকেরা কোন দিনই ন্যায্য দাম পায়না। পানির দরে বিক্রয় করে তারা। ফড়িয়া- মহাজনরা কিনে নেয়। তারা কাঁচা লঙ্কার দর নিয়ে লঙ্কাকান্ড বাধায়। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘‘ মজা মারে ফজা ভাই’’ । এ কথা দিয়েই কাঁচা লঙ্কার পাঁচালির ইতি টানতে চাই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট