ফেলে আসা দিন গুলো – এবাদত আলী

0

১৯৭১ সালে ঈশ্বরদীর দাদাপুর গ্রামের মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার ওয়াছেফ আলীর নেতৃত্বে আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম তারা হলো মোঃ জয়নাল আবেদীন, টুআইসি, (গ্রাম বিল কেদার, ঈশ্বরদী), আমি মোঃ এবাদত আলী (গ্রাম বাঙ্গাবাড়িয়া বাদলপাড়া, পাবনা সদর), মোঃ আব্দুল হামিদ (রাধানগর মক্তবপাড়া, পাবনা সদর), মোঃ রফিকুল ইসলাম রফিক (লক্ষপুর, আটঘরিয়া, পাবনা), মোঃ রাহাত আলী (গ্রাম বিলকেদার, ঈশ্বরদী), মোঃ আব্দুর রশিদ (গ্রাম বিল কেদার, শহীদ আটঘরিয়ার বংশিপাড়া রণাঙ্গন), আব্দুর রজ্জাক (গ্রাম দাদাপুর, শহীদ বংশিপাড়া রণাঙ্গন), আব্দুস সাত্তার (গ্রাম পাকশি, শহীদ বংশিপাড়া রণাঙ্গন), মনসুর আলী (গ্রাম তিলকপুর, শহীদ বংশিপাড়া রণাঙ্গন), নায়েব আলী (বিলকেদার, শহীদ বংশিপাড়া রণাঙ্গন), আব্দুল মালেক (পাকশি রুপপুর, শহীদ বংশিপাড়া রণাঙ্গন, তিনি জয় বাংলা জয় বাংলা বলতে বলতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন), ইউনুছ আলী (মুলাডুলি, শহীদ বংশিপাড়া রণাঙ্গন) মোজাফফর হোসেন (দাদাপুর, ঈশ্বরদী), আব্দুল আজিজ (লক্ষিকুন্ডা, ঈশ্বরদী), আবুল হোসেন (লক্ষিকুন্ডা, ঈশ্বরদী), হাবিবুল (লক্ষিকুন্ডা, ঈশ্বরদী, অ্যাডভোকেট, ঢাকা হাইকোর্ট), ইকবাল হেসেন (পাবনা শহর গোপালপুর, আমেরিকা প্রবাসি), লাভলু (পাকশি রুপপুর, ঈশ্বরদী), নুরুল ইসলাম (দাদাপুর, ঈশ্বরদী, পাবনা)।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওয়াছেফের নেতৃত্বে আমরা ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের মনোহরপুরে বিদ্যুতের টাওয়ার মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে পাবনা শহরের নুরপুর ডাকবাংলো, মেন্টাল হসপিটাল ও কাশিপুর শিল্পনগরীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অচল করে দেই।

তখন আষাঢ় মাস। আকাশে ভীষন মেঘ। কখনো বা থেমে থেমে আবার কখনো বা মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পথ-ঘাট পিচ্ছল। এরই মাঝে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি এই মুক্তিযোদ্ধা দলকে অর্থাৎ আমাদেরকে অপারেশনে বেরুতে হবে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সকলকে অপারেশনের স্থান ও পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত করানো হলো। কমান্ডার ওয়াছেফ আলীর নির্দেশ মোতাবেক সংক্ষিপ্ত আকারের একটা মহড়াও হয়ে গেল।

আর এ সব হলো পাবনা সদর থানার হিমায়েত পুর ইউনিয়নের চক চিরোট গ্রামের জনাব হারেজ আলী (টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালার সাবেক প্রধান শিক্ষক, বর্তমানে মৃত ) সাহেবের বাড়িতে।

সে সময় মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুবই কৌতুহলী ছিলো। কারণ তখনো পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় ঘটেনি। যাক, রাতের খাবার শেষ হতেই সকলকে কালো হাফ প্যান্ট ও কালো গেঞ্জি দেওয়া হলো। প্রয়োজনীয় সংখ্যক অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা বারুদ সাথে নিয়ে অন্ধকারে পথ চলা শুরু হলো। প্রায়২০/২২ জন মুক্তি সেনা চলেছে সারিবদ্ধ ভাবে। পিচ্ছল পথে পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে চলতে হচেছ সকলকে। কারো টুঁ শব্দ করার উপায় নেই। চকচিরোট হতে বের হয়ে গোপালপুর গ্রাম পেরিয়ে বাহাদুরপুর এবং কুমারগাড়ি হয়ে পাকা রাস্তা।
পাবনা-ঈশ্বরদী পাকা সড়কের পাশে অবস্থিত নজির সরকারের বাড়ি সোজা সুজি উত্তরে রয়েছে বিদ্যুতের বিরাটকায় টাওয়ার। ভেড়ামারা পাওয়ার হাউজ থেকে তখন একটি মাত্র গ্রিড লাইনের সাহায্যে পাবনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। তাই বিদ্যুতের টাওয়ার ধ্বংস করে দিতে পারলেই পাবনা শহরের নুরপুর ডাকবাংলো, মেন্টাল হসপিটাল ও কাশিপুর শিল্প নগরীর মিলিটারি ক্যাম্পের মিলিটারিদেরকে অতি সহজেই কাবু করা যাবে। সে মোতাবেক আমাদের দায়িত্ব বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করে দিয়ে পাবনা শহরে অবস্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প গুলোতে মুক্তিবাহিনীর অন্য গ্রুপদের হামলা করার সুযোগ করে দেওয়া।

ঘুট ঘুটে অন্ধকারে এক হাত দুরের বস্তুও চোখে পড়ছেনা। গ্রামের কোন বাড়িতে কোন লোক জেগে নেই। মাঝে মাঝে দু একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক শোনা যাচ্ছে মাত্র। এক সময় আমরা নজির সরকারের বাড়ির নিকটে পৌঁছে গেলাম। পুর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক দু’জন দ’ুজন করে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাকা সড়কের দু ধারে পজেশন নেওয়া হলো। পাকা সড়ক তখন যানবাহন শুন্য। ইচ্ছা করলে পাকা সড়কের উপর দাড়িয়ে অতি সহজেই নিরাপদে কাজ সমাধা করা যেতো। তা সত্তেও এত সতর্কতা এজন্যই যে যে কোন সময় পাকিস্তানি আর্মির টহল জিপ এসে পড়তে পারে। এ কথা ভাবতেই হঠাৎ করে আমাদেরকে শতর্ক সংকেত দেওয়া হলো।

আমরা যে যার মত আরো সাবধান হয়ে গেলাম। দুরে গাডির হেডলাইট চোখে পড়ছে। ক্রমেই আলো ও শব্দ কাছে আসছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি টহল জিপ। এইতো সুযোগ, হাতে তাক করে ধরা রাইফেলের ট্রিগারে দ্রুত আঙ্গুল চলে গেল। এখন শুধু কমান্ডারের আদেশের অপেক্ষা। কিন্তু না আমাদের সে হুকুম নেই। দেখতে দেখতে আরেকটি জিপ ও ঈশ্বরর্দীর দিকে চলে গেল। রাতের বেলা ওরা অতি সন্তর্পণে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। জিপ দ’ুটো অদৃশ্য হয়ে যাবার পর পুণরায় কাজ আরম্ভ করা হলো। পাকা সড়ক হতে সামান্য দূরে বিদ্যুতের টাওয়ার। টাওয়ারের আশে পাশে কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও বা কোমর পানি। তাই আঠালো মাটির মত কেমিকেলের প্রলেপ দেওয়া শক্তিশালী মাইন টাওয়ারের গায়ে সেঁটে দেওয়া হলো। এ দিকে পাটখড়ির সাহায্যে একটি সাঁকো মত তৈরি করা হয়েছে যাতে এক্সপ্লোসিভ পানিতে না পড়ে। ড্যাটোনেটর সেট করা হলে ফিউজে আগুন দেওয়া হবে।

সব কিছুই ঠিক ঠাক, এবার অগ্নি সংযোগের পালা। বুকের মধ্যে তখন ধুক ধুক করছে- চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে মনে। অপারেশন সাকসেস হতে চলেছে। সে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চকর অনুভুতি যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায়না। আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠতে মন চাইছে। নিশ্রিদ্র অন্ধকারে দেয়াশলাইয়ের একটি কাঠি জ্বলে উঠেই নিভে গেল। পুনরায় আরেকটি। পর পর দেয়াশলাইয়ের দু’টি কাঠি নিভে ফেলায় আগুন দেওয়ার দায়িত্বে যিনি ছিলেন তার উপর বিরক্ত হয়ে কমান্ডারের মুখ থেকে খিস্তি কিছু গালি বেরিয়ে গেল। পরের কাঠিটা বেশ কিছু সময় জ্বলে রইলো। একটু নিলাভ আভা চোখে পড়লো। যেন এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেলো। তার পর প্রচন্ড শব্দে যেন মহা প্রলয় ঘটে গেল। বিরাটকায় টাওয়ার মূহুর্তের মধ্যে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে টুকরো টুকরো হয়ে চ্ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.