পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট — মর্মান্তিক ও শোকাবহ ঘটনাবলি – এবাদত আলী

0

(পূর্ব প্রকাশের পর) (৬)
(১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ভোর প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘ তোরা কি চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’’ মেজর হুদা বলে ‘আামি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন ‘‘ তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কি করেছিস? উত্তরে হুদা বলে ‘ স্যার কামাল তার জায়গায়ই আছে আর আপনি তুই তুই করে বলবেননা। আপনি বন্দি, চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘‘ কি তোদের এত সাহস! পাকিস্তানি আর্মিরা আমকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে কেউ আমাকে মারতে পারেনা।’’ )।

দেশের বিশৃঙ্খলা রক্ষা তথা বিদ্রোহ দমনের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করেন। শুরুতে মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। বিদ্রোহ দমন এবং আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এই বাহিনী গঠিত হলেও এটা ছিলো একটি বিতর্কিত আধা সামরিক বাহিনী যা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অনুগত ছিলো। দেশে রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি হওয়ায় সেনাবাহিনীর বার্ষিক বাজেটের উপর তারা ভাগ বসায়। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর বার্ষিক ব্যয় বরাদ্দ কমে যায়। এতে সেনাবাহিনীর মাঝে নীরব ক্ষোভের সৃষ্টি হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি সেনাদের মধ্যে আশানুরূপ পদোন্নতি না পাওয়ায় সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ঘনিভুত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ৫৫ হাজার। তার মধ্যে পাকিস্তান প্রত্যাগত জোয়ানদের সংখ্যা ২৪ হাজার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের জোওয়ান ও নতুন করে রিক্রুট করা মোট মিলিয়ে সংখ্যা ছিলো ২৭ হাজার। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সংখ্যা ছিলো ১ হাজার ১ শত এবং রক্ষী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ২০ হাজার।

জাতীয় রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে কে এম শফি উল্লাহ বলেন, ‘‘ স্বাধীনতার পর দেশের আইন-শৃঙ্খলার কিছুটা অবনতি ঘটে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে অস্ত্র উদ্ধার করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়। কাজেই অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব আর্মিকে দেওয়া হতো। ঐসময় আমি এই দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম। সেটাকে লক্ষ্য করে পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়। কিন্তু এই বাহিনী সম্পর্কে কিছু মহল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা বলে যে, রক্ষী বাহিনী সেনা বাহিনীর বিকল্প হিসেবে গঠিত হয় এবং এ মর্মে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। রক্ষীবাহিনীকে কার্যকর করার জন্য পার্লামেন্টে আইন পাশ হয়, যাতে রক্ষীবাহিনীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে অপপ্রচার হয় এবং সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ দেখা দেয়।

ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বইয়ের লেখক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এর বর্ণনায় ‘ সেনাবাহিনীতে সীমাহীন অপপ্রচার এবং ভুল বোঝাবুঝির ফলে শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। এমতাবস্থায় গ্রুপিং দলাদলির কারণে সেনাবাহিনীতে ষড়যন্ত্রকারি গোষ্ঠির তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা খাকি বর্ণের পোশাক পরিধান করতে রাজি ছিলেননা। পাকিস্তানের সমরিক বাহিনীর পোশাক খাকি রঙের হওয়ায় তারা তা অপছন্দ করতেন। ফলে সরকার তাদের জন্য জলপাই সবুজ পোশাক বরাদ্দ করে যা ছিলো ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুরূপ। এসব কারণে রটিয়ে দেওয়া হয় তারা ভারতীয় বাহিনীরই অংশ। মুজিব সরকারের প্রতি বিদ্বেষের এটাও একটি অন্যতম কারণ।

কথিত আছে এক ভুখা মিছিলে মাওলানা ভাসানী একদল রক্ষীবাহিনীর সদস্যকে তাদের জেলা, গ্রাম কোথায় তার খোঁজ খবর নিয়ে তাঁর পাশে থাকা কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননকে বলেন, ‘‘ তোমরা না কও রক্ষীবাহিনীর সবাই ভারতীয়? আমি তো দ্যাখতাছি এরা আমাগো পোলা। তৎকালিন সেনা প্রধান কে এম শফি উল্লাহ বলেন, রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১২ হাজার হলেও সর্বত্র প্রচারিত ছিলো তার সংখ্যা ১ লাখেরও বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো সেনাবাহিনীতে জিয়া- শফি উল্লাহর দ্বন্দ। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে নানা কারণে বিভেদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসারদের মধ্যে দুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেনা প্রধান নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। সিনিয়র হওয়া সত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিয়াউর রহমানের পরিবর্তে শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান নিযুক্ত করেন।

কে এম শফিউল্লাহর ভাষ্য মতে ‘‘ ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আমাকে চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি এই নিয়োগের প্রতিবাদ করি। কারণ জিয়াউর রহমান ও আমার একই রকম যোগ্যতা থাকা সত্বেও তিনি ব্যচ নম্বর-এ আমার আগে ছিলেন অর্থাৎ আমার ১ নম্বর সিনিয়র ছিলেন। আমি মেজর রবকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এই প্রতিবাদ জানাই। প্রতিবাদ দেওয়ার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় দুই ঘন্টা আলাপ হয়। তিনি আমার সব কথা শোনার পর বলেন, ‘‘ তোমার সব কথা শুনেছি। দেয়ার ইজ সামথিং কলড পলিটিক্যাল ডিসিশন। এখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে কিছু আছে। উত্তরে আমি বলেছিলাম, আজ থেকে এবং এখন থেকে আমি পরিস্থিতির শিকার। বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমরা বড় বড় কথা বলো। যাও কাল থেকে তুমি জেনারেল ওসমানীর নিকট থেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে নাও। জিয়াউর রহমানকে টেলিফোনে আমার দায়িত্ব পাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপের বিষয় বিস্তারিত জানাই। জিয়া তখন বলেন, ওকে শফি উল্লাহ। গুড বাই।

এটা ছিলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যার ফলে জিয়াউর রহমান ব্যক্তিগত ভাবে মুজিব সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হন। এর ফলে জিয়াউর রহমান ও কে এম শফি উল্লাহর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কে এম শফিউল্লাহ আরো বলেন, আমি যখন কোন অফিসারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে ব্যবস্থা নিয়েছি তখন ঐ সকল অফিসার জেনারেল জিয়উর রহমানের নিকট শেল্টার নিয়েছে। ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বই এর লেখক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের মতে সব সময়ই সেনাবাহিনীতে প্রচার চলতো যে, সকল গুন ও মেধার আকর জিয়াউর রহমান। অনেকের মতে পাকিস্তান প্রত্যাগত ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বন্দলাগাবার জন্য জিয়াউর রহমান দায়ী ছিলেন। জাসদের উদ্যোগে প্রতিটি সেনানিবাসে অত্যন্ত গোপনে গঠিত হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এর ফলে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা চরমভাবে বিনষ্ট হয়। কর্নেল আবু তাহের ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী সরকারের সমর্থক, আওয়ামী লীগের সদস্য ও পুলিশদের হত্যার মাধ্যমে অভ্যুত্থানে লিপ্ত হয়। এর ফল দেশের আইনশৃঙ্খলায় সম্পুর্ণ ভাঙন ধরে এবং মুজিব হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়।। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

লেকক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.