কৃষি উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে

0

হীরেন পণ্ডিত : ২৭ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ঘোষিত ইশতেহারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, গণতান্ত্রিক চর্চার প্রসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আর্থিক খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ইশতেহারে আরো বলা হয়েছে, সরকার কৃষির জন্য সহায়তা ও ভর্তুকি তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণে বিনিয়োগ সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখবে। ব্যবহারযোগ্য কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা হবে। বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো-টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবেলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ অব্যাহত থাকবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ২০২৮ সালের মধ্যে গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা ১ দশমিক ৫ গুণ বৃদ্ধি করা হবে। বাণিজ্যিক দুগ্ধ, পোলট্রি ও মৎস্য খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনীয় ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে।

জনগণের বিবেচনায় ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হয়েছে, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ করোনার কারণে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এলডিসির সুবিধাগুলো বজায় রাখার জন্যই বাংলাদেশ এ অনুরোধ করে। অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু করা, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিলো ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিলো ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২১টি বিশেষ অঙ্গীকারে ছিলো এটিতে।

এমডিজি অর্জন এবং এসডিজি বাস্তবায়ন কৌশলের (২০১৬-৩০) অংশ হিসেবে এমডিজি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন অর্থাৎ এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাসস্থান, খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন সুবিধা, শিশু ও মাতমৃত্যু হার হ্রাস, সমতা নিশ্চিতকরণসহ প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আর্থসামাজিক উনয়নের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নতুন কৌশল উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও ইশতেহার ঘোষণার সময় জানানো হয়।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার করে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘বিগত ১৫ বছরের সরকার পরিচালনার পথপরিক্রমায় যা কিছু ভুলত্রুটি তার দায়ভার নিজের এবং সকল অর্জনের জন্য জনগণকে সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়েছেন। তিনি অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহবান জানিয়েছেন। তিনি অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অঙ্গীকার করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা এগুলো উল্লেখ করেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন ‌আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকা সত্তে¡ও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সবসময়ই যে আমরা শতভাগ সফল হয়েছেন, এমন দাবি তিনি করেন না। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আওয়ামী লীগ যা বলে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন তার প্রমাণ। তবে মাঝে-মধ্যে মনুষ্য-সৃষ্ট, প্রাকৃতিক এবং বৈশ্বিক বাধাবিপত্তি আমাদের চলার গতিপথকে মন্থর করে দেয়।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ বিস্তারের চেষ্টা মোকাবেলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়েছে। ২০০৯ সালের পর থেকে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে ২০২০ সালে যখন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এ মহামারী গোটা বিশ্বের অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছিল।

পর্যালোচনা করে বলা যায়, আওয়ামী লীগ দলটির এ নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবানুগ। কারণ এতে সাম্প্রতিক সময়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য পেয়েছে। আওয়ামী লীগ নতুন ইশতেহারে বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সংগতি প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রæতি রয়েছে । এ ছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের কাতারে নিয়ে যাওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি মুদ্রানীতির বিষয়েও ব্যাপক জোর দিয়েছেন। মুদ্রানীতির সফল বাস্তবায়ন করা গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে যা যা করা প্রয়োজন তার সবকিছুই করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে কৃষি ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং কৃষকের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে। তবে অন্যান্য শিল্পের উন্নয়নের জন্যও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে। সবকিছু ছাপিয়ে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রসঙ্গটিই উঠে এসেছে ঘুরেফিরে। মানুষের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহার ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রæতি রয়েছে ইশতেহারে। শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের জন্য শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণ, সবুজ কারখানা স্থাপন, কর্মক্ষেত্রে অধিকার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, শিল্প খাতের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল সাধারণ মানুষের চাহিদাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়েই নির্বাচনী ইশতেহার সাজানো হয়েছে। দেশের মানুষ সমাধানের জন্য রাজনীতিকদের কাছেই প্রত্যাশা রাখেন। আওয়ামী লীগ মানুষের আকাক্সক্ষার বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। সুবিধাবঞ্চিত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী এবং বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী। দেশের মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাতে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শিল্পের অন্যান্য খাতেও। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সবুজ কারখানা স্থাপনের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব দেশের অর্থনীতির দুই বিষফোঁড়া। দুর্নীতি দমনে সরকারের আগে থেকেই জিরো টলারেন্সের কথা এবং অবস্থানের অঙ্গীকার রয়েছে। এবার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আরও যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে ইশতেহারে।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। এ উত্তরণ যেমন একদিকে সম্মানের, অন্যদিকে বিশাল চ্যালেঞ্জেরও। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সক্ষমতা থাকতে হবে। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি আরো একবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেওয়ার আহবান জানান। তিনি উল্লেখ করেন আপনারা আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধি দিব।

‘সবার জন্য খাদ্য’ এই অঙ্গীকারকে সামনে রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের ইশতেহারে কৃষির উন্নয়ন জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনগণের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি। এ দেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে, শিল্পের কাঁচামাল জোগানে ও রফতানি আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে কৃষির। তাই স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষিবিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারও রাষ্ট্র পরিচালনায় কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চালের উৎপাদন সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বর্তমানে ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এছাড়া পাট উৎপাদনে ২য়, চা উৎপাদনে ৪র্থ এবং আলু উৎপাদনে ৭ম অবস্থানে আমাদেও দেশ। দেশি-বিদেশি ফল আবাদের অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে বেশ। কফি, কাজুবাদাম, গোলমরিচ, মাল্টা, ড্রাগনসহ অপ্রচলিত কিন্তু লাভজনক বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে কৃষকদের। ২০০৬ সালে মাথাপিছু ফল গ্রহণের হার যেখানে ছিল ৫৫ গ্রাম, ১৫ বছরে তা বেড়েছে ২০২৩ সালে হয়েছে ৮৫ গ্রাম। ১৫ বছরে দেশে উদ্ভাবিত হয়েছে ৬৯৯টি বৈরী পরিবেশে সহনশীল, উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল এবং প্রায় ৭০৮টি প্রযুক্তি।

এ ছাড়া যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিকে আধুনিকায়ন করার কাজ চলছে। ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে কৃষকদের মাঝে। তিন হাজার কোটি টাকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলমান আছে। সব মিলিয়ে দেশের কৃষিব্যবস্থা ‘জীবন নির্বাহী’ কৃষি থেকে ‘বাণিজ্যিক কৃষি’তে রূপান্তরিত হচ্ছে।

এই ধারা অক্ষুন্ন রাখতে এবার ইশতেহারে পরিকল্পনার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন কৌশল অনুসরণের অঙ্গীকার করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, সবার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসম্মত খাদ্য সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোর উনয়ন, কৃষি ও অকৃষিজ পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এই কৌশলের লক্ষ্য। বরাবরের মতো বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে এবারো।
‘সবার জন্য খাদ্য’ আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য ও অঙ্গীকার। কৃষি, কৃষক-কৃষাণী ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন কৌশল অনুসরণের ধারা অব্যাহত থাকবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, সব মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসম্মত খাদ্য সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, কৃষি ও অকৃষিজ পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এই কৌশলের লক্ষ্য। বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হবে।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গৃহীত কর্মসূচি আগামী দিনে আরও সম্প্রসারিত হবে বলে অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধুকন্যার। কৃষিঋণ সহজলভ্য ও সহজগম্য করার লক্ষ্যে ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে কৃষিঋণ দেয়া অব্যাহত থাকবে; কেন্দ্রীয় ব্যাংক শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে পুনঃঅর্থায়ন করবে। ফলে কৃষিঋণ বিতরণে আরও উৎসাহিত হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এছাড়া কৃষির জন্য সহায়তা ও ভর্তুকি তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণে বিনিয়োগ সহায়তা অব্যাহত রাখবে আওয়ামী লীগ। সেইসঙ্গে কৃষিতে শ্রমিকসংকট লাঘব এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহজে ব্যবহারযোগ্য কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করা হবে। ভর্তুকি দেয়া অব্যাহত থাকবে কৃষি যন্ত্রপাতিতে।

আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যেই কৃষি উৎপাদন আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব জমি আবাদের আওতায় আনার নীতি বাস্তবায়ন করছে। শেখ হাসিনার অঙ্গীকার, কোনো জমিই অনাবাদি থাকবে না। সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলায় গুরুত্বারোপ করা হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, রফতানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ সর্বোপরি আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের গুরুত্বও অপরিসীম। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর প্রাণিজ চাহিদা পূরণে উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান তৈরি ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখার লক্ষ্যে তাই মৎস্য ও গবাদি পশুখাতেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার।

২০২৮ সালের মধ্যে গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা দেড়গুণ বৃদ্ধি করা হবে। বাণিজ্যিক দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামার প্রতিষ্ঠা, আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনীয় ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দেয়া হবে। গুণগত মানসম্পন্ন পশুখাদ্য উপকরণের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তির প্রসার ও যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করা হবে। উৎপাদিত প্রাণিজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিমুখী শিল্পের প্রসার করা হবে। ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে বাণিজ্যিক খামার ম্যাকানাইজেশন ও স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা হবে।

সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারপূর্বক খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে টেকসই মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন ৪৯ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন থেকে ৫৮ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করা হবে এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে জনপ্রতি মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রাম থেকে বৃদ্ধি করে ৭৫ গ্রামে উন্নীত করা হবে। সুনীল অর্থনীতির বিকাশ সাধনে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণ ও দায়িত্বশীল মৎস্য আহরণ নিশ্চিত করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, অভিযোজন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ডেল্টা হটস্পটভিত্তিক প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
ভ্যালু চেইন উন্নয়নের মাধ্যমে মৎস্যসম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, বৈচিত্র্যময় ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মৎস্য অপচয় ১০ শতাংশ হ্রাস করা হবে এবং এ খাতে আগামী ৫ বছরে প্রায় ৬ লাখ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। মৎস্য ও মৎস্যপণ্য রফতানি বৃদ্ধিতে রফতানিমুখী মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করা হবে; দেশের বাইরে নতুন নতুন বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমদানিকারক উদ্বুদ্ধকরণে ফিশ এক্সপো আয়োজন এবং মৎস্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রফতানি আয় ৪ হাজার ৭৯০ কোটি থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হবে।

প্রাণিসম্পদ-গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চলমান কর্মসূচিকে বিস্তৃত করা হবে। এসব পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও মূল্য সংযোজনের লক্ষ্যে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে। পুকুরে মাছ চাষ এবং যেখানে সম্ভব ধানক্ষেতে মাছ চাষের আরও প্রসারের জন্য উন্নত জাতের পোনা, খাবার, রোগব্যাধির চিকিৎসা অব্যাহত রাখা হবে। খামারিদের জন্য সুলভে পুঁজিসংস্থান ও বিদ্যুৎ-সংযোগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া অব্যাহত রাখা হবে।

হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.