স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কের অবসান হোক
হীরেন পণ্ডিত : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো মেজরের বাঁশির ফুতে এদেশ স্বাধীন হয়নি। জাতির পিতার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনায় বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করেও শেখ হাসিনা বলেন, সবাই ভারতে পালালে যুদ্ধ করলেন কারা। জিয়ার জন্ম ভারতে, বড় হয়েছেন পাকিস্তানে, আর পদায়ন হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। কোনো মেজরের বাঁশির ফুতে এদেশ স্বাধীন হয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করায় বিএনপির বড়াই করার কিছু নেই। জিয়াউর রহমান আওয়াম লীগ সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন।
মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন তিনি।’ ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতির পালা শুরু হয় দেশে। সকল মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন জিয়াউর রহমান। আর ক্ষমতা দখলকারীদের দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব না।
বিএনপি নেতা ড. মঈন খানের বাবা ছিলেন ওই সময় খাদ্যসচিব, তার ভুল তথ্যের কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলেও জানান শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অনেক দেশ সহায়তা করলেও বড় কিছু দেশ বিরোধিতা করেছিল।
স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সব পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার মধ্যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল বলেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এখনও ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় এসব বলেন তিনি। বিএনপি নেতারা গণতন্ত্র খুঁজে পায় না। বড় বড় কথা বলে যাচ্ছে। দলটি বলছে, ২৫ শে মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ নেতারা নাকি পালিয়ে গিয়েছিলো। তাহলে বিজয় আনলো কে, সরকার কে গঠন করলো কে? তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা পেয়েছি। আবার বড় বড় দেশের বৈরিতা পেয়েছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যারা সহযোগিতা করেছে তাদের সম্মান দেয়া হয়েছে।’
আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটু গবেষণা করি বা একটু জানার চেষ্টা করি দেশি, বিদেশি পত্রপত্রিকা, গবেষণাপত্র এবং পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বইপত্র পর্যবেক্ষণ করি, তাতে কোথাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কারো নাম উজ্জ্বলভাবে পাওয়া যায় না। মাওলানা ভাসানী সম্পর্কেও পাকিস্তানিদের বইয়ে প্রশংসামূলক বক্তব্য আছে, কিন্তু শেখ মুজিবকে নিয়ে তাদের কোনও বইয়েই একটি প্রশংসাবাক্য নেই, নিন্দা ছাড়া।
পাকিস্তান ভাঙার জন্য এখনও পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই গালি দেয়। সেই সময়ের পাকিস্তানিদের কারো লেখায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের নামের উল্লেখ পাওয়া যায় কি? অনেক গবেষক এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও সংগঠকদের কাছ থেকেও একই তথ্য জানা যায়।
বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে খবর বা বিশ্লেষণে বারবারই বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ হয় বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে, বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে। তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধকালে যে সব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, তারা আর কারো নয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ করছেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি শেখ মুজিব তার অনুপস্থিতিতেই যে একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে কথা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ আছে বলে জানা যায়।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা প্রায় প্রত্যেক পাকিস্তানী বাংলাদেশ ও বাঙালিদের সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ করেছেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী করেছেন। তাদের কোনো আলোচনাতে জিয়াউর রহমানের নাম কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপরও যারা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে দাঁড় করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন, এটি জনগণের সাথে মানুষের সাথে হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি এতই স্পষ্ট এ নিয়ে বিতর্ক করাই এক ধরনের মূর্খতা ও বোকামি।
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় এরকম কোনো আয়োজনে কোনো দুঃসাহস দেখায়নি কেউই, এমনকি মেজর জিয়াও কখনও ঘোষণার বিষয়টিকে বিতর্কিত বলে মন্তব্যও করেননি, দাবি তো দূরের কথা। কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার এক আয়োজন ও অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কারণ ১৯৭৯ সালে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত দল ও ব্যক্তিদের প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় এই দলটি। এক পর্যায়ে তাদের ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ এই পাপ মোচনের জন্যই হয়তোবা একজন ঘোষক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়। এর জন্য বেছে নেয়া হয় জিয়াকে কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া, তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীর সেই ব্যক্তি যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ‘পাঠ’ করেছিলেন। বিএনপির এই দাবি প্রবল হয়ে দেখা দেয় ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর। তারা আন্দোলন ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতার অনিবার্য ফলাফল অস্বীকার করে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেয়া জিয়াউর রহমানের বেতার-ঘোষণাটিকেই অনেক বড় করে দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধাকে প্রতিষ্ঠিত করতে মনগড়া ইতিহাস গড়ার প্রয়াস চালিয়েছেন।
কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণা কোন প্রতিযোগিতা নয় যে কেবল একজন মেজর একটি বাঁশিতে ফু দিলেন আর হ্যামিলনের মতো সব পিছনে দৌঁড় শুরু করে দিলো। এই বিষয়টি জিয়াউর রহমানের অনুসারীরা বুঝতে পারেননি, বুঝতে চানও না কোনদিন। একটি জাতির স্বাধীনতার লড়াই কোনো একদিনের ব্যাপার নয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া কোনো একজন মেজরের বেতার-ঘোষণারও ব্যাপার নয়।
১৯৪৭ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির প্রধান আকর্ষণ। বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাস তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তরুণ শেখ মুজিব ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা। নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দারি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা হয়। এরপর ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে একাত্তরের মার্চের শুরুতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমাদের অনিবার্য। তাই তিনি একাত্তরের ৭ মার্চ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ভাষণে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র মূর্ত হয়ে ওঠে। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, ‘ তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
৭ মার্চের মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাঙক্ষার প্রতিফলন, যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’
অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কখনো তাঁরা বিচার করেন না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন দেশের অভ্যন্তর থেকে বিদেশি হানাদার-শত্রু বিতাড়নের একটি যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের ৯ মাস সময় লেগেছিল ওই শত্রুদের বিতাড়ন করতে। আমরা ওদের বিতাড়ন করতে সক্ষম হই বলেই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, ওই ঘোষণাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিভূমি, অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র বা বাংলাদেশের সংবিধানের মাতৃকোষ ঘোষিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এই ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচিত হয়। তাই ১৯৭১ সালে ৯ মাস বাংলাদেশে যে যুদ্ধ হয় তা ছিল নিজ স্বাধীন দেশকে হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত করার যুদ্ধ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আসা একটি স্বাধীন দেশের জন্য সব মানুষ এই যুদ্ধ করে। স্বাধীন বাংলাদেশ নামক যে দেশটি ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে জন্ম নিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তখন তারা একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেন, তিনি বা তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে এভাবে গ্রেফতার হওয়ার ভেতর দিয়ে, স্বাধীনতা ঘোষণার পরে এই দেশটির আর বাকি যে বিজয় অর্জন করার ছিল তার বেশিরভাগ তিনি একাই করেন। বিশ্বে প্রায় এককভাবে লড়াই করেন গ্রেফতার হওয়া নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যেকোনো মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন দেশের মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে হয়, তেমনি তার সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে দাঁড়ায় সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ। সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর নায্যতা দিয়েছিলেন বন্দি স্বাধীন রাষ্টপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
জনগণের কূটনীতিতে সেদিন ইয়াহিয়াকে পরাজিত করেছিলেন বন্দি বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে, সশস্ত্র পথে হানাদার তাড়ানোর যুদ্ধে সেদিন বঙ্গবন্ধুর কূটনীতির কাছে হেরে যায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু, রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে। অনেকেই ভুল করে বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন।
তা ছাড়া কেউ ইচ্ছা করলেই একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন না। স্বাধীনতা ঘোষণা করার এখতিয়ার বা অধিকার থাকতে হয়। যিনি ঘোষণা করবেন, তার প্রতি তার দেশের এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন থাকতে হবে। স্বাধীনতার ডাক দিলেই জনগণ এতে সমর্থন দেবে না। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অধিকার ছিল।
স্বাধীনতার পক্ষে দেশবাসীকে তিনি ধাপে ধাপে উদ্বুদ্ধ ও প্রস্তুত করে তুলেছিলেন বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং কেউ একজন এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলেই দেশ স্বাধীন হয়নি। ইতিহাসের ঘটনাক্রম ও বঙ্গবন্ধু পরস্পর এমন অবিচ্ছিন্নভাবে এগিয়েছে যে সেখানে শেখ মুজিব ছাড়া আর কারও পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া সম্ভবই ছিল না।
রাজনীতির প্রবল ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে জিয়াউর রহমানের মতো একজনকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগটা বিএনপি গ্রহণ করেছে মূলত চট্টগ্রামের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে প্রচারিত ঘোষণাটিকে পুঁজি করে। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল সেই ঘোষণাটি? কোনো সামরিক লোক নয়, বরং স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করার কথা বেতার কেন্দ্রের কর্মীরাই প্রথম ভেবেছিলেন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে। ঘোষণা তো বঙ্গবন্ধু আগেই দিয়ে রেখেছেন তার ৭ মার্চের বক্তৃতায়,
কিন্তু বেতারের কর্মীরা বঙ্গন্ধুর ‘স্বাধীনতার ডাক’ জনসাধারণে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমানকে বেছে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের তখনকার কর্মকর্তা বেলাল মোহাম্মদ জানিয়েছেন, জিয়াউর রহমানকে ডেকে নিয়ে এসে তারা স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করান। স্বল্পকালের জন্য চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র যখন বিদ্রোহীদের দখলে আসে, তখন ২৬শে মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান এবং ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় ৮ ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা পাঠ করেন।
স্বাধীনতার আহ্বান বা ঘোষণা যে কেউ করতে পারে না। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। স্বাধীনতার ঘোষণা করতে পারেন, এমন একজন নেতা যিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে একটি জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করে আসছিলেন। মানুষও এমন একজন নেতার আহ্বানে সর্বস্ব নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে যিনি নিজের জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে তাদের ভালোবাসা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। জিয়াউর রহমানকে একাত্তরের ২৭ মার্চের আগে জনসাধারণ দূরে থাক, দেশে রাজনীতিবিদরাও চিনতেন না। কীভাবে চিনবেন? জিয়াউর রহমান ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর।
১৯৭১ সালের শেষ দিকে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ বিষয়টি স্পষ্ট করেছে যে ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত ঘোষণার ভিত্তিতেই সারা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে মধ্যরাতে ঢাকায় ইপিআর ও পুলিশ ব্যারাকের ওপর হামলার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত বার্তা বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে কোনো কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান জীবিত থাকা অবস্থায় কোনো দিন বলেননি যে, তিনিই স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন অথবা জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রয়াত লে. কর্নেল আকবর হোসেন, প্রয়াত লে. কর্নেল মীর শওকত আলী এবং জীবিত কর্নেল অলি আহমদও (বীর বিক্রম) জিয়ার জীবদ্দশায় কোনো দিন দাবি করেননি, জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। জিয়া ১৯৭৩ সালে বিচিত্রা ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুস্পষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দেয়ার কথা বলেন এবং বঙ্গবন্ধুর উচ্চ প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরও জিয়া বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন।
বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেই ক্ষান্ত থাকেননি, তারা জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। স্পষ্টতই বোঝা যায় আজও বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো জাতির এই নিষ্পত্তিমূলক ও স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের খেলা খেলছে।
উল্লেখ্য অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হননি। তিনি তাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি নিরাপদ স্থানে চলে যাই, পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে না পেয়ে অধিক মাত্রায় গণহত্যা চালাবে, জনগণও আমাকে ভুল বুঝতে পারে।’ তারপর বঙ্গবন্ধু রাত ১২র পর আনুষ্ঠানিকভাবে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার মেসেজটি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। রাত ৩টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে অজানা স্থানে নিয়ে যায়। অন্যদিকে পরের দিন ২৬ মার্চ বেলা ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট