বিজয় দিবস ২০২০ । মোহীত উল আলম

0

এবারের বিজয় দিবসের সময় দেশ একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়েছে। করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ চলছে, এবং যদিও দেশ হিসেবে খুব একটা ঘায়েল আমরা এই মহামারী দিয়ে এখনো হয়েছি বলা যাবে না, কিন্তু নিশ্চিতভাবে অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও এই ঘা শুকিয়ে নিতে সময় লাগবে। এটার সঙ্গে প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল যে বছরটা আসলেই ছিলো বিশে বিষ। সবচেয়ে বড় আগ্রহ ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের উৎসব পালন করা। সেটা আর হয়ে উঠলো না। দুই ঈদ গেল উৎসববিহীন, সে সাথে দূর্গাপূজাবুদ্ধপূর্ণিমা। আর কয়েকদিন পরে যে বড়দিন আসছে, তারও আর কোন উৎসব হতে পারবে মনে হয় না। আর আজকে যে বিজয় দিবসের ৪৯তম উদযাপন বার্ষিকী তারও কিছু হলো না। কিন্তু এই সবকিছু থেমে থাকার মধ্যেও আশ্চর্যভাবে দেশ চলছে। হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে, ব্যবসাকেন্দ্রে পূর্ণবেগে না হলেও ৬০/৭০ ভাগ কর্মশীলতা ফিরে এসেছে। এবং মনে হয়, করোনার প্রকোপ আরো বাড়লেও হয়তো আমাদের মানুষেরা আর ঘরে ফিরে যাবে না।

আমাদের উন্নয়নের ছবির সর্বোত্তম প্রতীক হচ্ছে পদ্মা সেতু। গত ১০ ডিসেম্বর লেগে গেল ৪১ নম্বর স্প্যানটি। ১২ এবং ১৩ নম্বর পিলারের ওপর এই স্প্যানটি বসলো। এটি বসার পর দৃশ্যমান হলো ৬.১৫ কিমি (৩.৮২ মাইল) দীর্ঘ মূল সেতু। অর্থাৎ পদ্মা নদীর ঢাকার পাড় মাওয়া আর বৃহত্তর ফরিদপুরের পাড় জাজিরার সঙ্গে কাঠামোগত যোগাযোগটা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর রাস্তা বসবে, রেলবিট ফেলা হবে, ডাক ও তার যোগাযোগ টানা হবে, হয়তো এগুলির জন্য আরো বৎসরাধিক সময় লাগতে পারে। তবে এই পদ্মা সেতুকে প্রতীক হিসেবে দেখে বিজয় দিবসের উদ্দীপনার সঙ্গে যুক্ত করে পরবর্তী বক্তব্যে যেতে চাই। বাংলাদেশের জন্মই পুরো বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময় ছিল। যাও বা জন্ম নিল, তখন কথা রটে গেল যে বাংলাদেশ হলো বিশ্বের তলাবিহীন ঝুরি। এই উক্তিটি নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু মোদ্দা কথা হলো এইটা ছিল নবীন একটি দেশের জাতিসত্তার প্রতি ঘোরতর অপমান। এই অপমানের পারদ একেবারে চূড়ায় গিয়ে ঠেকল যখন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য অর্থ সরবরাহকারী সংস্থা কল্পিত ও অপ্রমাণিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের প্রতিশ্রুত ঋণের অংক সম্পূর্ণ তুলে নিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় দেশনেত্রী শেখ হাসিনা কঠিন হয়ে দাঁড়ালেন, ঠিক যেরকম তাঁর পিতা ৭ মার্চ মঞ্চে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সেনাসরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” শেখ হাসিনা বললেন, পদ্মা সেতু হবে, টাকা বাংলাদেশই দেবে। এই নিজস্ব অর্থায়নের দুর্দান্ত ফসল পদ্মা সেতু। টাকা লাগল কত? ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

কোন ব্যাপারই না। আজকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা দিয়ে করলে এই খরচতো দ্বিগুণ হতোই, এবং সাথে সাথে প্রতি কিস্তী শোধ করার সময় সুদ গুণতে হতো মূল ঋণের অনেক বেশি টাকা। বাংলাদেশের উন্নয়ন কি শুধু পদ্মা সেতু হয়ে থেমে যাবে? নাকি আরো আরো সেতু হবে? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেখা টেনে দেখলে বুঝতে পারি, বাংলাদেশে এই তরফের আরো বহু উন্নতি হবে না শুধু, হতে বাধ্য। কর্নফুলীর টানেলটা যখন তৈরি হয়ে যাবে, তখন কি মনে হবে না যে নদীর তলা দিয়ে সড়ক এবং রেল টানা আগে আমাদের মজ্জায় ছিলো যে শুধু উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব এবং চিন ও রাশিয়ার দ্বারা সম্ভব, কিন্তু এখন আমরাইতো করে ফেলছি। জাপানের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি, কীভাবে এত দ্রুত ট্রেন তারা চালায়? হয়তো এক দশকের মধ্যেই দেখে ফেলব যে আমরাই সুপার ট্রেন চালু করেছি, আর বিশ্ব তাকিয়ে আছে হা করে। কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, “সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী / অবাক তাকিয়ে রয় / জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার / তবু মাথা নোয়াবার নয়।” মাথা যখন নোয়াবার নয়, তখন মৌলবাদী মোল্লাদের কাছেও মাথা নোয়াবার কোন প্রশ্ন ওঠে না। মূর্তি-ভাষ্কর্য বিতর্কের বিষয়তেতো নয়ই। প্রথমে বলি, মূর্তি এবং ভাস্কর্যের মধ্যে নির্মাণ-পদ্ধতি ও নির্মাণ উপকরণের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। অর্থাৎ, যে সব উপায়ে মূর্তি তৈরি করা হয়, যেমন ধরুন মাটি পুড়িয়ে, বা বালু সিমেন্ট-ইট-লোহা ব্যবহার করে এবং স্বর্ণের বা অন্য কোন ধাতুর পলেস্তারা দিয়ে, সে সব উপায়ে ভাষ্কর্যও তৈরি হয়। কিন্তু মূর্তি যখন আইডল বা দেব-দেবীর প্রতিরূপ হিসেবে তৈরি হয়, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে পুজা নিবেদন করা হয়, তখন সেগুলি মূর্তি; আর যে মূর্তিগুলি ধর্মীয় কারণে নয়, কিন্তু ভাস্কর্যের অন্যতম উদ্দেশ্য মোতাবেক শৈল্পিক কর্ম সৃষ্টি করা, সেগুলি হচ্ছে ভাষ্কর্য। ভাস্কর্য ব্যক্তিত্বের স্মারক হিসেবে নির্মাণ করা হয়, কিংবা মনুষ্য প্রতিকৃতি ছাড়াও পশুপাখি, প্রকৃতির নানা নিদর্শন, কিংবা কোন একটি এ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে ভাষ্কর যেটিকে তৈরি করেন সেটাকে ভাষ্কর্যরূপে অভিহিত করা হয়।

কিন্তু মৌলবাদী নেতারা বিষোদ্গার করে চলেছেন যে মূর্তি এবং ভাস্কর্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং এই সূত্র ধরে সামাজিক মাধ্যমে বহুজন ইসলামে গান গাওয়া নিষিদ্ধ, ছবি আঁকা নিষিদ্ধ এ-সব কথাও বলা শুরু করেছেন। কিন্তু মানবসমাজ জীবনাচরণের ক্ষেত্রে প্রমাণিতভাবে দেখা গেছে শুধু একটি উপকরণ নিয়ে কখনো চলেনি, চলবেও না। মানবসমাজে ধর্ম যেমন আছে, তেমনি আছে সংসার প্রতিপালন, অর্থনীতি, রাজ্যনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য সহ কলা-কৈবল্য ও সংস্কৃতি চর্চা। মৌলবাদীরা যতোই গলা উঠাক, কিন্তু মানবসমাজ মৌল সমাজ নয়, কৌম সমাজ। এবং মানুষও জীবকোষ অনুযায়ী, তার সত্তা অনুযায়ী কোন মৌল রূপ নিয়ে চলে না। একজন মানুষের একাধিক সত্তা থাকে, এবং প্রতিটি সত্তার প্রকাশ কাল ও স্থান-নির্ভর। উগ্রবাদী ধর্মচর্চায় মানুষকে কেবল একটি চেতনাধারী সত্তা হিসেবে দেখার ভয়াবহ প্রবণতা সৃষ্টি হয়। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো বিস্তার লাভ করার আগেও মানবসমাজে মূর্তি তৈরি, গান গাওয়া, ছবি আঁকা, নাচ করা, বিজ্ঞান চর্চা হয়ে এসেছে, এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো মানবসমাজকে এগুলি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। খোদ ইসলামিক পৃথিবীতে সব দেশেই মূর্তির অস্ত্বিত্ব, ভাষ্কর্যের অস্ত্বিত্ব, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, গান গাওয়ার অস্ত্বিত্ব যে আছে, সেটা নিয়ে এন্তার ভিডিও চিত্র সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এসে ভরে গেছে। আমরা মৌলবাদী মোল্লাদের তর্কের খাতিরে যদি মেনেই নিই যে কোন ইসলাম-প্রধান দেশে মূর্তি, ভাষ্কর্য, গান, মানুষের প্রতিকৃতি সংবলিত চিত্রকলা সবকিছুকে মোবাইল থেকে ডিলিট করার মতো ডিলিট করে দিতে হবে, তা হলে আমাদেরকে পনেরশ বছরের ইসলামের ঐতিহ্যের আশি শতাংশ বাদ দিয়ে দিতে হবে। তা হলে কেমন হবে? আফগানিস্তানে ধর্মীয় মৌলবাদিতার নামে জীবন-বিরোধী ও নারী-বিরোধী যে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনের প্রবর্তন হয়েছে, সেই সমাজে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত হোক সেটি কার কাঙ্খিত? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি, অর্থাৎ ভাষ্কর, কিন্তু মৌলবাদী মোল্লাদের একটি বক্তব্য হলো বঙ্গবন্ধুকে সহ্য করা হবে, কিন্তু তাঁর ভাষ্কর্যকে সহ্য করা হবে না। এবং এই বক্তব্যে উত্তাপ পেয়ে কুষ্টিয়ায় চার মৌলবাদী বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাষ্কর্যে আঘাত করে তাঁর মুখ থেঁতলে দিয়েছে, আর হাত গুঁড়ো করে দিয়েছে। এটা যেকোন সমাজের জন্য চিন্তার বাইরের ব্যাপার। ইসলামী দুনিয়ার সবচেয়ে শৌর্যবীর্যধারী দেশ হলো তুরষ্ক, এবং এরোদাগানের নেতৃত্বে তুরষ্ক কড়া ডানপন্থী শাসনে চলছে। কিন্তু সে তুরস্কতেও তাদের দেশের স্থপতি কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য ভাঙার সাহস কেই করবে সেটাতো দূরের কথা, কারো চিন্তায়ও সেটা আসবে না। তুরষ্ক ঘুরে আসা আমার একাধিক পরিচিতজনের কাছে শুনেছি তুরষ্কের পথে ঘাটে কামাল আতাতুর্কের মূর্তি সহ বহু নেতার শৈল্পিক ভাষ্কর্য আছে। আর ধোলার পাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে এত ক্ষেপে যাওয়ার কিন্তু কোন কারণ নেই, যদি এর তলে রাজনৈতিক অভিসন্ধি না থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য আমার দেখা মতে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলির আশে পাশেই আছে গোটা পঞ্চাশেক।

আর শহরের ভিতরে বাইরে এবং গ্রামাঞ্চলে আছে শতশত। এগুলি আগে থেকেই আছে, সেগুলি নিয়ে কোন বিক্ষোভ হলো না, কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশ যখন জবুথবু পর্যায়ে আছে সেসময়ে এভাবে ভাষ্কর্য নিয়ে বিতর্ক তোলা ও তা নিয়ে আষ্ফালন করার পেছনে মৌলবাদী মোল্লাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশের প্রগতিমুখীনতাকে ব্যাহত করে পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক প্রচ্ছায়ার মধ্যে দেশকে পিছিয়ে নেবার এজেন্ডা বাস্তবায়িত করা। ঠিক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল শামস, আল বদররা মিলে যেমন চেয়েছিলো বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান নির্বিচারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধকে পরাস্ত করে বাঙালিকে চিরদিনের জন্য পদানত করে রাখতে। বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় প্রেরণার উৎস। তাঁর সম্পর্কে বই থাকতে পারলে, ছবি থাকতে পারলে, অন্যান্য নানাবিধ প্রকাশ থাকতে পারলে তাঁর মূর্তি থাকলে অসুবিধা কি? ভাস্কর্য আমাদের সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী মাধ্যম। তাই একটি উগ্রবাদী অসহিষ্ণু এবং সর্বোপরি অনৈতিহাসিক চাপের মুখে আমরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের একটি দিককে বিসর্জন দিব তা হতে পারে না। কাজেই যে কোন যুক্তিতে উগ্রবাদী, অসহিষ্ণু ও অনৈতিহাসিক ধর্মীয় চিন্তার সম্প্রসারণ কাম্য নয়।

লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ,ত্রিশাল,ময়মনসিংহ

 

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.