স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস: সীমাহীন আনন্দের বাঙালির ইতিহাস। ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

0

আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি,—স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের ১০জানুয়ারি পাকিস্তানে কারাবাস শেষে বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতা তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। জাতির জনক নিজেই তার এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে।

বাঙালি জাতির মহান মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই দিনটির কথা খুব মনে আছে। ইতিহাসের দিন তো বটেই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে ফিরেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন । লক্ষ জনতাকে সামনে রেখে স্মৃতি কাতর হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন “ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।” অহো কী মধুর স্বগতোক্তি! তাইতো লাখো বাঙালি অপেক্ষা করছিল – উত্তেজনার সেই দিনটার জন্য। উল্লাসের শীর্ষে উঠে গিয়েছিল আমার দেশের আপামর জনতা।

বছরের দিনপঞ্জীতে সময়টা ছিল শীতকাল। দুপুরবেলাটি ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। বিকেল গড়াচ্ছে, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুকে বয়ে আনা বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সকাল থেকেই বিমানবন্দর ছিল জনসমুদ্র। শুধু তেজগাঁ বিমানবন্দর কেন, রমনা রেসকোর্স পযন্ত লোকে লোকারণ্য। ঢাকার সেদিনের স্মৃতির কথা শুনেছিলাম আমার প্রয়াত চাচা ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডি আই টি) এর কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান সরকারের কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন, দেশে ফিরছেন, খবরটি যে যেখানে শুনেছেন, ঢাকার দিকে ছুটে এসেছেন। যে বেশে বাড়িতে ছিল, দোকানে ছিল, অফিসে ছিল, খেলার মাঠে ছিল সেই পোশাকে। বনানীর অভিজাতপাড়ার লোকেরা ছুটে এসেছেন লুঙ্গি পড়ে, কনকনে শীতের মাঝেও উদোম গায়ে বা শুধু গেঞ্জি পড়ে সবাই উল্লাসে ফেটে পড়েছে। সেকালের বনানীর বাসিন্দা আমার চাচার কাছ থেকে জেনেছিলাম শয়ে শয়ে পুরুষ মহিলা শিশু বৃদ্ধ রমনা থেকে তেজগাঁ বিমানবন্দরে গণ আনন্দে ধাবমান হচ্ছিল ভোরবেলা থেকেই। দোকানের মালিক,কর্মচারী, অফিস আদালতের কর্মকর্তা, কর্মচারী, পিয়ন, ড্রাইভার, ছাত্র – জনতা সকলে মিলে জনস্রোত তৈরী হয়েছে রাস্তার অলিগলিতে। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু গর্জন বড় রাস্তায় এসে মুহুমুর্হু বিস্ফোরিত হয়েছে। জনস্রোত এতটাই ছিল যে জাতির জনক একটি খোলা ট্রাকে তেজগাঁ বিমানবন্দর থেকে রমনা রেসকোর্সে পৌছতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টা। সেখানে অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রে জনস্রোত দেখে চাচার স্পষ্ট মনে হয়েছে কোথায় শীত! কীসের কুয়াশা! মনে হয়েছে চৈত্রের দুপুর। জনসভায় সবাই ঘামছে দরদর করে। উত্তেজনায় জনসমুদ্র অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই মহান নেতার, জাতির জনকের তিনি কী শোনাবেন। কোথায় ছিলেন? কেমন ছিলেন। আসলেই ঠিক তাই, জাতির পিতাও বলতে শুরু করেন, “ ভাইয়েরা আমার, লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও।”
আমার চাচার মতো লাখো জনতা সেদিন উপস্থিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জনসভায়। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনি তুলে অন্যদের মত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে শুধু গেঞ্জি গায়ে সেদিন উপস্থিত হয়েছিল তার সমবয়সী অন্য সকলের মতো। সবাই যেন ইতিহাসের সাক্ষী । ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর এর পাকিস্তানী বর্বর নির্যাতন অত্যাচারের ইতিহাস জানানোর জন্য জনসভায় । তাইতো বঙ্গবন্ধু এদিন তাঁর বক্তৃতায় বললেন,“ বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশরূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নাই।” অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বঙ্গবন্ধু আরো বললেন, “ গত ১০ মাসে সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরান করেছে। বাংলার লাখে মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য লোক গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই । বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমি সাহায্যের আবেদন জানাই। বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি- বাংলাকে স্বীকৃতি দিন। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় অত্যন্ত ভালবাসি।” ‘সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি।’ আত্মপ্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, “কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে, এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই।” বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১৭ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। যা ছিলো জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকল বাঙালি অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের এই বরপুত্রকে। দিনটিকে বাঙালি জাতির শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা উচিত।

[ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলোচনায় আমার বক্তৃতা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত।]

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.