মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই । বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মাহমুদ

0

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় ৫০বছর। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রস্তুত হলো না।শুধু যাচাই বাছাই চলছে এবং তা কতবার হলো তার হিসাব করা কঠিন। যা খুশি তাই।এ যেন এক বিশাল তামাশার ক্ষেত্র।যখন যে দল ক্ষমতায় সেই দলের লোকজন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠাচ্ছে। সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তাদের কোন জবাবদিহিতা নাই। দায়িত্ব হীনতার জন্যই এমনটি হচ্ছে বলে সকলেই মনে করচ্ছেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও কম হয়নি। সবচেয়ে মজার ব্যপার হলো হালে একাত্তরের রাজাকারদের একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছিল আর সেখানে কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তরভুক্ত করা হয়েছিল। আশ্চর্য্যজনকভাবে এই কাজটি যারা করলো তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় নি এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখন হাসি তামাশার পাত্র হয়েছে। অথচ এই মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ না করলে সবাইকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হতো। স্বাধীনতা সুফল ভোগ করছেন অথচ যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলো তাদের বেলায় এত অবজ্ঞা কেন ? আসলে আমাদের কৃতজ্ঞতা বোধের অনেক অভাব।

আবার ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই শুরু হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। আর কত এর কি কোন শেষ নেই নাকি কোন করণে জিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিবার যাচাই বাছাই হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা আর তার সাথে কিছু সরকারি কর্মকর্তা বা আমলা এবং আর কিছু লোক থাকে যারা ভয়ানক অর্থ লোভী দুর্নীতি পরায়ন। যার কারণে কোন যাচাই বাছাই ই সুষ্ঠু হয় নাই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পর সঠিকভাবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রস্তুত করা একটি জটিল কাজ। দীর্ঘ দিন অতিক্রান্ত হওয়ায় বহু স্বার্থপর, দুর্নীতিবাজ, লোভী, নির্লজ্জ, বেঈমান, বিবেকহীন, ঘৃন্য মনোভাবাপন্ন মানুষের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদেরকে মোকাবিলা করে এই মহৎ কাজটি করতে হবে যা সত্যিকার অর্থে একটি চ্যলেন্জিং কাজ। এর সফলতা নির্ভর করবে যাচাই বাছাই কারিদের বলিষ্ঠ ভূমিকা, নৈতিক তা, সৎ মানসিকতা, সততা ও আন্তরিকতার উপর।
ইতিপূর্বে প্রতিটা যাচাই বাছাই এর ক্ষেত্রেই পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল। সেজন্য যাচাই বাছাই যদি করতে হয় তাহলে ত্রুটিগুলো সংশোধন করে পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে এবং সকল প্রকার প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ যাচাই বাছাই করা দরকার। আর সেজন্য যা করতে হবে :-

১। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই এর জন্য সংসদে সুনির্দিষ্ট আইন পাস করে সেই আইনের অধীনে যাচাই বাছাই করতে হবে। যাতে করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা একটি আইন গত ভিত্তি পায়। ইচ্ছে করলেই কেউ যেনো বদলাতে না পারে।
২। যাচাই বাছাই কমিটিতে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি, কোন দু্র্নীতিবাজ ও অর্থ লোভী লোক থাকতে পারবে না। শুধু দায়িত্বশীল সেনাবাহিনীর লোক দিয়ে যাচাই বাছাই করাতে হবে। সেখানে কোন মন্ত্রী, এম পি বা অন্য কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কোন ভূমিকা থাকবে না। সকল প্রকার প্রভাবমুক্ত থেকে সম্পুর্ন নিরপেক্ষভাবে যাচাই বাছাই হয় তা নিশ্চিত করতে হবে হবে। ৩। প্রথমে সকল মুক্তিযোদ্ধা দাবিদারগনের নিকট থেকে কে কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তার বিস্তারিত লিখিত বিবরণ নিতে হবে এবং ইতিমধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের বৈধ ওয়ারিশগন উক্তরুপ বিবরন ও তার সাথে সহযোদ্ধাদের নাম সরবরাহ করবেন। যাচাই বাছাই কালে তাদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

৪। সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অন্য যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে স্বীকৃতমতে সঠিক মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন করে তাদেরকে সংগে নিয়ে তাদের সম্মুখে যাচাই বাছাই করতে হবে এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গমন, কেন্দ্রের বিবরণ, প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণের বিষয় ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাহলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাই ও নির্ধারন করতে সুবিধা হবে।
৫। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর লোক সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে এলাকার বয়স্ক লোকদের নিকট থেকে গোপনে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করবেন। ৬। যাচাই বাছাই কালে কোন মহলের সুপারিশ, তদবির, স্বজনপ্রীতি চলবে না।কেউ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গন্য হবে এবং শাস্তি প্রদান ও তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৭। কোন সার্টিফিকেট এর চাইতে প্রাপ্ত তথ্যের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ স্বার্থ হাসিলের জন্য স্বার্থান্বেষী মহলের অনেকেই অনেক কৌশলে দুর্নীতিবাজদের সহযোগিতায় বিভিন্ন ভুঁয়া ও ভিত্তিহীন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা লুটিয়ে নিয়েছে ও নিচ্ছে। অনেক প্রকৃত মুক্তি যোদ্ধার নামে কোন সার্টিফিকেট এখনো ইস্যু হয় নাই। সে বিষয়টি আন্তরিক ভাবে বিবেচনায় নিতে হবে ও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করতে হবে। ৮। মুক্তিযুদ্ধের পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেই সংজ্ঞা মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধা নির্দ্ধারণ করতে হবে। সেটা হলো :
BANGLADESH ( FREEDOM FIGHTERS) WELFARE FOUNDATION ORDER,1972.
Order no.94 of 1972.Published on 7th August 1972.
উক্ত আইনের উপধারা ( h) এ মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ” freedom fighter ” means any person who had served as a member of any force engaged in the war of Liberation but shall not include members of the defense service or police or the civil armed forces.
এই সংজ্ঞাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে দিয়ে গেছেন।
” পরবর্তীতে ২০১৬ সালে যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয় বরং অন্য কোন ভাবে সম্মানিত করা উচিৎ হবেএবং সেই ভাবে তাদের জন্য পৃথক তালিকা করা যেতে পারে।তাদেরও অবদান আছে সারা বাংলাদেশের নির্যাতিত ও অবর্ননীয় কষ্ট সহ্যকরা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা মানুষের ও অবদান আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন নাই। বিষয়টি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।”
” মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছে তাদের সাথে অন্য কাউকে যুক্ত করা হলে তাদের ত্যাগ ও অবদানকে ছোট করা হবে। কোন মুক্তিযোদ্ধা কোন অর্থ বা অন্য কোন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশায় নয় বরঞ্চ জীবনের মায়া ত্যাগকরে জীবনের বিনিময়ে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। তাদের সাথে অন্য কারো কোন তুলনা হয় না এবং করাও উচিৎ নয়।তাদের জন্যই তৈরী করতে হবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের তালিকা। ”
৯। যাচাই বাছাই কালে কেউ ভুঁয়া সাব্যস্ত হলে বা মিথ্যা তথ্য দিয়েছে এমত সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। সেক্ষেত্রে সামান্যতম দয়া বা করুণা প্রদান করা যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পর মুক্তি সঠিকভাবে প্রকৃত মুক্তি যুদ্ধ তালিকা প্রস্তুত করা একটি জটিল কাজ। দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হওয়ায় বহু স্বার্থপর, দুর্নীতিবাজ,অসাধু লোকের আনাগোনা বেড়েছে।তাদেরকে মোকাবেলা করেই এই পবিত্র কাজটি করতে হবে।

তাই এই বিষয়টির প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধ বিসয়ক মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট সকল মাননীয় সংসদ সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আর কালক্ষেপন না করে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান করুণ। সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষ আপনাদেরকে চিরদিন স্মরণে রাখবে।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু
।। বাংলাদেশ চিরজীবী হউক।।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী ।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.