পরিবেশ রক্ষার কথা যেন ভুলে না যাই । কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ।

করোনাভাইরাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো আপাতবিচ্ছিন্ন দুটি বিপর্যয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি কি বিশ্ব নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পারছে? জলবায়ু পরিবর্তনকে বাগে আনার ক্ষেত্রে ঘুমন্ত ও উদাসীন বিশ্ব নেতা-নেত্রীদের জেগে উঠার জন্য আর সময় বেশি অবশিষ্ট নেই। তাদেরকে জেগে উঠে দায়িত্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে পৃথিবীকে বাঁচাতে। অন্যথায় পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ ধ্বংসের মুখে নিপতিত হবে।

0

এই অভূতপূর্ব করোনা বিশ্ব-মহামারি পৃথিবীর দেশে দেশে তাণ্ডব চালিয়ে আসছে কয়েক মাস ধরে। বাংলাদেশে এর ভয়াবহতা বর্তমানে দ্রুত বাড়ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে প্রায় সবকিছু। কিন্তু তার মধ্যেও পরিবেশ সুরক্ষার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এটা ঠিক, করোনা পরিস্থিতিতে কল-কারখানা, যান্ত্রিক পরিবহন বন্ধ থাকায় পরিবেশ দূষণ খানিকটা কমেছে। একটি হিসাবে দেখা গেছে, করোনার কারণে বিমান, রেল ও অন্যান্য পরিবহন এবং শিল্প-কারখানা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ২০২০ সালে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ গত বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মতো কম হবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। ভালো, তবে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে বছরে গড়ে আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশের মতো কমাতে হবে প্রতি বছর আগামী বছরগুলোতে। করোনা পরিস্থিতিতে যেভাবে সব বন্ধ ছিল, তখনও কি তা থাকবে? ভুলে যাওয়া চলবে না, লকডাউন উঠে গেলে পরিস্থিতির অবনতি হতে সময় লাগবে না।

 

সন্দেহ নেই, করোনাভাইরাস আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সামনে এনেছে পরিবেশ, প্রতিবেশ সুরক্ষার গুরুত্বও। বস্তুত জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিশ্বে যে নতুন নতুন ভাইরাস সংক্রমণ ঘটতে পারে বা পুরোনো ভাইরাস নতুন করে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেকবারই ব্যক্ত হয়েছে। এছাড়া অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ আক্রমণের সঙ্গে মারাত্মক বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্পর্কও থাকতে পারে।

আমরা দেখছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগও থেমে নেই। এরই মাঝে ২০-২১ এপ্রিল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে পরিবেশ, অর্থনীতি ও অবকাঠামোর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সুন্দরবন আবারও বাংলাদেশকে রক্ষা করে আরও ভয়াবহ অভিঘাত থেকে। আবার এখন দেখা যাচ্ছে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় ‘নিসর্গ’ আঘাত হেনেছে ভারতের মহারাষ্ট্র ও গুজরাট উপকূলে। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বই নতুন করে উপলব্ধি করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর অস্তিত্ব কতটা হুমকির মুখে রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, করোনাভাইরাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো আপাতবিচ্ছিন্ন দুটি বিপর্যয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি কি বিশ্ব নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পারছে? জলবায়ু পরিবর্তনকে বাগে আনার ক্ষেত্রে ঘুমন্ত ও উদাসীন বিশ্ব নেতা-নেত্রীদের জেগে উঠার জন্য আর সময় বেশি অবশিষ্ট নেই। তাদেরকে জেগে উঠে দায়িত্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে পৃথিবীকে বাঁচাতে। অন্যথায় পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ ধ্বংসের মুখে নিপতিত হবে। আর তা ঘটবে ওই নেতা-নেত্রীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে। তা হতে দেওয়া যায় না। সবাইকে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।

বাংলাদেশের সামনেও চ্যালেঞ্জটি একইভাবে কঠিন। সেই আলোকে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে সময়মতো ও স্বচ্ছতার সঙ্গে। সঙ্গে নিতে হবে ভুক্তভোগী সব মানুষকে। উপকূল ও উপকূলের মানুষ, প্রান্তিক কৃষক এবং অন্যান্য শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ যাতে আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সেদিকে নজর দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুন্দরবন, উপকূল, হাওর ও নদনদী দখলদারদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার, পুনরুজ্জীবন ও সংরক্ষণে কার্যকরভাবে মনোযোগী হতে হবে।

পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইন, বিধি ও উচ্চ আদালতের নিদের্শনা কম নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদের সংবিধানেও পরিবেশ সুরক্ষার অঙ্গীকার সংযোজন করা হয়েছে। আমরা দেখছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ সুরক্ষায় শূন্য সহিষ্ণু বা জিরো টলারেন্ট অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এখন প্রয়োজন আসলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদিচ্ছা মাঠ পর্যায়ে প্রতিফলিত হওয়া। অর্থাৎ আইনের প্রয়োগ এবং নতুন করে দখল, দূষণ, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চলতে না দেওয়া। এক্ষেত্রে সরকার ও নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
একইভাবে করোনাভাইরাস নিরোধে বিশ্ববাসীকে এককাট্টা হয়ে কাজ করতে হবে। প্রতিষেধক বের হলে সব দেশের সব মানুষ তা যেন পেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। করোনা মহামারিতে দেশে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও পুনর্জাগরণে সব দেশ নিজ নিজ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে অবশ্যই। কিন্তু তা হতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া অসংখ্য মানুষকে কেন্দ্রে রেখে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে কার্যকরভাবে- নীতিতে তা-ই আছে, বাস্তবে সেরকমই ঘটতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ইতোমধ্যে শুরু হওয়া বিশ্বমন্দা যা বিশ্ব-মহামন্দার দিকে যাচ্ছে, তা থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিস্কৃতি লাভ করা যায়।

জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিজ্ঞান বলে, আমাদের হাতে মাত্র কয়েক বছর সময় আছে, যার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতে পারে যদি দ্রুত প্রয়োজন পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা যায়। এক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব উন্নত বিশ্ব এবং অধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর। অবশ্য নিজেদের বাস্তবতা অনুযায়ী সব দেশকে অবদান রাখতে হবে। বাংলাদেশ এত কম গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে যে এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়দায়িত্ব নেই তবুও বাংলাদেশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কিছু কমাতে অঙ্গীকার করেছে।

কভিড-১৯-এর মতো মহামারির প্রাদুর্ভাব আগামীতে ঘটলে তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে এখন থেকে বিশ্ববাসীকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। আর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পৃথিবী এখন ধার করা সময়ে আছে, এখনই সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। দুই দুর্যোগই আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে কথাটি আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান : পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউণ্ডেশন (পিকেএসএফ) ।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.