সুলতানা রাজিয়ার সমাধিতে । ড. মো আনোয়ারুল ইসলাম
আছে প্রেম, ভালোবাসা, রাজ্য, রাজত্ব , শাহজাদা, রাজা, রাণী সহ সকলেই। যেখানেই যাচ্ছি অবাক বিস্ময়ে দেখছি আর নিজের পড়া ভারতবর্ষের ইতিহাসকে শাণিত করছি। আজ শ্যামা পুজা হবার কারণে দিল্লীতে সরকারী ছুটির দিন।
৫ নভেম্বর ১৯৯১। কালকা মেলের দেড় দিনের ট্রেন ভ্রমণ শেষে কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে এসে পৌঁছালাম। হাজার বছরের পুরণো দিল্লী। এ শহরের অলিতে গলিতে লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে কত রকমের ইতিহাস। সেই ইতিহাসে জড়িয়ে আছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীস্টান জৈনসহ সকল ধর্মের আবেগ। কি নেই তাতে । আছে প্রেম, ভালোবাসা, রাজ্য, রাজত্ব , শাহজাদা, রাজা, রাণী সহ সকলেই। যেখানেই যাচ্ছি অবাক বিস্ময়ে দেখছি আর নিজের পড়া ভারতবর্ষের ইতিহাসকে শাণিত করছি। আজ শ্যামা পুজা হবার কারণে দিল্লীতে সরকারী ছুটির দিন। বেশীরভাগ টুরিস্ট স্পট বন্ধ থাকবে বলে সকালেই আমাদের টুরিস্ট গাইড আসতে পারবেনা বলে জানিয়ে গেল। আবার ট্যুরিস্ট স্পটের বেশীরভাগই টুরিজম এবং প্রত্ন অধিদপ্তরের হবার কারণে বেড়ানোর জায়গাগুলোও বন্ধ থাকবে।
আমরা উঠেছি পুরনো দিল্লীতে জামে মসজিদের পাশে চাউরি বাজারের এক হোটেলে। হোটেলের রুম থেকেই মসজিদ দেখা যায়। হোটেল চয়েজের জন্য সবাই হাসনাইনকে ধন্যবাদ দেয়া হলো। কিন্তু দিল্লী বেড়াতে এসে শুধু হোটেলে থাকলেই তো চলবে না। ছুটির দিনে কোথায় বেড়ানো যায় এই নিয়ে বাদশা স্যার ছোট খাট একটা মিটিং সেরে ফেললেন। দলের মধ্যে আজিজ ভাই খুব রসিক মানুষ । কোলকাতা দিল্লী ট্রেন জার্নি খুব এনজয় করেছেন। এখনো তিনি এক কাপ চা নিয়ে এই চায় গরম, চায়, চায়- পাপড় বলতে বলতে মিটিংয়ে হাজির।
মিটিংয়ে দুই রকমের প্রস্তাব। কামরুল হাসান , শাহীন খান, লিটন ওদের ইচ্ছা চাদনী চকে বাজার করার। আমি হাসনাইন, আসলাম, দেলোয়ার ভাই সহ অন্যরা বেড়ানোর দলে। হঠাৎই বাদশা স্যার প্রস্তাব দিল ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক সুলতানা রাজিয়ার সমাধিতে বেড়াতে যাবার। আমরা কয়েকজন বাদশা স্যারের সাথে বেড়িয়ে পড়লাম ইতিহাসে পড়া এক মহিলা সুলতানের সমাধি সৌধ দেখতে। কিন্তু সুলতানা রাজিয়ার সমাধি সৌধ কোথায় তা আমাদের কারো জানা নাই। অন্যদিকে আমাদের ভাষা সমস্যা। কেউ হিন্দি বলতে পারিনা। আমাদের একমাত্র বাদশা স্যার কিছু কিছু হিন্দি বলেন। স্যার অবশ্য গর্ব করে মাঝে মধ্যে বলেন আমি যখন পাতিওয়ালা ছিলাম তখন তো হিন্দিতেই কথা বলতাম!
দুই একজন ট্যাক্সিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এটা দিল্লির তুর্কমান গেটের ওদিকে। আমরা জামে মসজিদের ২নং গেট থেকে অটো নিয়ে নিলাম্। কিন্তু অবাক ব্যাপার তুর্কমেনি গেট পযন্ত অটো এলেও কবরস্থান পযন্ত যায় না। অগত্যা আমরা বাকি রাস্তা হেঁটেই ভারতের প্রথম মহিলা মুসলিম শাসকের কবরের দিকে যেতে থাকলাম। এগলি সেগলি আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি বলে অবহেলিত এক গলির মাথায় পাওয়া গেল এক সমাধি সৌধের ঠিকানা । অনেকটা অবহেলিত ও পরিত্যক্ত বা পোড়াবাড়ির মত। যেখানে চির শায়িত সুলতানা রাজিয়া। জায়গাটা বুলবুল ই ফরাশ খানা নামে পরিচিত। জায়গাটা চাদনী চকের পিছনে অথচ ট্যাক্সিওয়ালা ঘুড়িয়ে এনেছেন বলে বাদশা স্যার বেশ খানিকটা বকবক করতে লাগলেন।
দিল্লির সুলতানী আমলের হেরেম কুশক ই ফিরোজী প্রাসাদে বড় হওয়া রাজকুমারীর সমাধি সৌধের বেহাল অবস্থা দেখে যে কেউ বলবে সুলতানা রাজিয়ার ইতিহাস হয়ত সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়নি। এক সময়ের ভারতেশ্বেরী। মহিলা শাসক হয়েও যিনি নিজ নামে মুদ্রা জারী করেছিলেন আজ তাঁর সমাধি সৌধের এই বেহাল অবস্থা! বাদশা স্যার একথা শুনেই হেসে ফেললেন। তিনি বললেন হ্যা তো তোমার কাছে প্রাসাদের নাম শুনেই মনে হচ্ছে এলাহী ব্যাপার। বাদশা স্যারের এটা মস্তবড় গুন। রাগ বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না।
হ্যা স্যার এলাহী ব্যাপার তো বটেই। সুলতানা রাজিয়ার পিতা সুলতান ইলতুতমিশ খুব জাকজমক পছন্দ করতেন। দরবার খুব ঐশ্বযময় ছিল। সুলতান নিজে রঙিন পোষাক পরতেন সোনারূপার বাসনকোসন রেশমী পর্দা নানা প্রকার খাদ্যদ্রব্য পান সুপারীর দ্বারা পরিপূর্ণ করে রাখতেন। ফসলে মুশাব্বা নামে এক শ্রেণীর আমির ওমরাহ দরবারে পরিপূর্ন থাকতেন।
সুলতানা রাজিয়াও কিন্তু কম ছিলেন না। তাঁর পরনের পোষাক, মাথারমুকুট ছিল চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। যখন সূর্যের আলো মাথার মুকুটে এসে পড়ত তার মনি মুক্তাগুলো আলোর ছটায় চোখ ঝলসে যেত। এতটাই মূল্যবান রত্নখচিত ছিল তা! আর তিনি যেখানে থাকতেন সেই প্রাসাদ শাহী মহলের চুড়া ছিল সোনায় তৈরি রত্নখচিত। সুলতানের সওয়ারকে বলা হতো শাহী সওয়ার। সেখানে হাতির পিঠে সুলতানা রাজিয়া বহু রকমের রঙিন ছাতায় মেলে যেতেন। ডানে বামে থাকত হাতি ঘোড়ার বহর। যেখানে সৈনিকেরা খাপ খোলা তরবারি প্রদর্শন করত। সুলতানা রাজিয়ার শাহী সওয়ার মনে করেই আমীর খসরু লিখেছিলেন তাঁর মুখ ছিল পর্দার আড়ালে, তলোয়ারটি ছিল খাপে ঢাকা। কিন্তু দুটোর তেজই সমান, ঠিক ঝলমলে বিদ্যুতের মতো।
আমার কথায় সবাই যেন অপ্রস্তুত। এই রকমের একজন রাজকীয় ব্যক্তির অন্তিম স্থানের ভগ্ন দশা মনে হয় সবাইকে ব্যথিত করল। তবে দেলোয়ার ভাই একটু বেশী ব্যথিত হলেন তা তার কথায় স্পষ্ট বোঝা গেল।
কবরস্থান একেবারে সাদামাঠা। তেমন কোন ভীড় বা কোলাহল নাই। অনেকটাই নির্জন। তবে আমাদের দেখে বয়স্ক একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। উনি গাইড হিসেবে আমাদের জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাবেন।
আইয়ুব ভাইয়ের অদ্ভুত হিন্দি উচ্চারণে গাইড একটু ভড়কে গেলেন। পরে জানলাম ভদ্রলোকের নাম রিজাউল সেখ। গাইডের কাজ করেন। আমাদেরকে ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব নিলেন রিজাউল সেখ। তিনি সুলতানা রাজিয়ার কবরটি দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু পাশাপাশি দুইটা কবর হওয়াতে আমাদের মনে কিছুটা সন্দেহ থেকে গেল। যদিও পাশের কবরটি তার বোন সাজিয়ার বলে গাইড রিজাউল সেখ জানালেন।
কিন্তু আমি স্যারকে বললাম স্যার এখানে তো একটু গড়বড় মনে হচ্ছে।
কী রকম।
সুলতানা রাজিয়ার তো কোন বোন ছিল তার উল্লেখ নাই। আমরা সব সময় পড়ে এসেছি সুলতান ইলতুতমিশের চার সন্তান ছিল। এর মধ্যে তিনজন ছেলে এবং একজন মেয়ে। এই মেয়েটিই সুলতানা রাজিয়া।আমার কথাতে সায় দিল আসলাম। তবে তাঁর প্রশ্ন থেকেই গেল। ইলতুতমিশের তিনজন পুত্র সন্তান থাকা সত্ত্বেও কেন রাজিয়াকে সিংহাসনে বসানো হলো। এটা কি কন্যা সন্তানের প্রতি স্নেহ প্রবণতা নাকি নারীর ক্ষমতায়ন। বাদশা স্যার বললেন চলো গাইড রিজাউল সেখের পরীক্ষা নেই। স্যার গাইডকে প্রশ্নটি হিন্দিতে করলেন। রিজাউল সেখ অবশ্য জানালেন কন্যার প্রতি স্নেহ ছিল বলেই সুলতানা রাজিয়া ক্ষমতায় বসতে ইলতুতমিশ সহযোগিতা করেছিলেন।
আমি বললাম না স্যার উত্তরটি ঠিক হলো না। আসলে ইলতুতমিশ সব সময় যোগ্যতার মূল্যায়ন করতেন। তিনি সব সময় নীচ বংশের এবং অযোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের তিনি অপছন্দ করতেন। তারিখ ই ফিরুজশাহীতে এরকমের অনেক উদাহরণ আছে শুধুমাত্র নীচ বংশের হবার কারণে ইলতুতমিশ তাদের কে কোন পদ পদবি দিতেন না। তবে তাঁর পুত্রদের মধ্যে যোগ্য ছিলেন নাসির উদ্দিন মাহমুদ। তাঁকে সুলতান ইলতুতমিশ লাখনৌতির বা বাংলার শাসনকর্তা বানিয়েছিলেন। লাখনৌতিতে সে সময় গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজী শাসন করছিলেন এবং দিল্লীর বিরুদ্ধাচরণ করেন। গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজীকে নাসির উদ্দিন মাহমুদ পরাজিত ও নিহত করেন। তাঁর রাজভান্ডার বাজেয়াপ্ত করে সমস্ত ধন দৌলত দিল্লীতে প্রেরণ করেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদকে ইলতুতমিশ খুব ভালোবাসতেন। তাঁর লাখনৌতি জয়ে তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন। একবার ইলতুতমিশ বাগদাদের খলিফার নিকট থেকে বহু মূল্যবান উপহার সামগ্রী পেয়েছিলেন তা থেকে তিনি একটি লাল রংয়ের ছাতা এবং কাপড় নাসির উদ্দিনের নিকট বাংলায় প্রেরণ করেন।
কিন্তু বাংলার সিংহাসন লাভের দেড় বছরের মাথায় নাসির উদ্দিন মাহমুদ অসুস্থ হয়ে মারা যান। এতে ইলতুতমিশ খুবই দু:খ এবং ব্যথিত হন। তিনি পরবর্তীতে তাঁর কনিষ্ঠ পূত্রের নামও রাখেন নাসির উদ্দিন মাহমুদ। ইলতুতমিশ বিভিন্নভাবে পুত্রদের পরীক্ষা নিয়েছেন। একমাত্র সুলতানা রাজিয়াই যোগ্যতার মানদন্ডে উর্ত্তীণ হয়েছিলেন। একারণে গোয়ালিয়র অভিযানে যাবার পূর্বে সুলতান ইলতুতমিশ রাজ্য সুরক্ষার ভার রাজিয়ার উপর অর্পন করেন এবং এ সময় তাঁর রাজ্য পরিচালনা সুলতানকে মুগ্ধ করে। সুলতানও গোয়ালিয়র অভিযান শেষে রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। সুলতান তাঁর সচিবকে ডেকে পাঠান এবং দলিল প্রস্তুত করতে বলেন। সচিব মানে । তখন কি সচিব ছিল না কি। আইয়ুব ভাই হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে বসল।
সচিব অবশ্যই ছিল। সচিবের নাম ছিল তাজ উল মূলক মাহমুদ। আমি বাংলাতে বললাম। আসলে ফারসীতে তাঁর উপাধি ছিল মোশরিফ ই মামলুকাত এবং কাজ ছিল দবীর বা সেক্রেটারি বা সচিবের। তাঁকে দিয়েই সুলতান ইলতুতমিশ আদেশ বা ফরমান তৈরি করেন। এ সময় অনেক মন্ত্রী যাদেরকে ওই সময়ে আমীর বলা হতো তারা বাধা দিয়েছিলেন। আমীরগণ প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। তাদের বক্তব্য
“ যেখানে সুলতানের বয়প্রাপ্ত পুত্রগণ আছেন[ এবং তাঁরা] সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারেন সেখানে কন্যাকে ইসলামের বাদশাহ ও রাজ্যের উত্তরাধিকারী করার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এ রাজকীয় দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ কি? ভৃত্যদের মন থেকে এ সংশয় দুরীভূত করতে আজ্ঞা হোক যেহেতু ভৃত্যগণ এ কার্য যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করে না।”
সুলতান বললেন, “ আমার পুত্রগণ ভোগ বিলাস ও যৌবনের (প্রমত্ততায়) মগ্ন এবং রাজ্য শাসন করার ক্ষমতা কারোর নেই। তাঁদের দ্বারা রাজ্য শাসন করা সম্ভব হবে না। আমার মৃত্যুর পর আপনারা উপলদ্ধি করবেন যে রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে তাঁরা কেউ তাঁর ( আমার কন্যার) চেয়ে যোগ্যতর হবে না।” স্যার বললেন নিশ্চয় এখানে সুলতানা রাজিয়া সম্পর্কে কিছু লেখা থাকার কথা। বাদশা স্যার সেটা গাইড রিজাউল সেখকে জানাতেই তিনি একটা ফলক দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু এখানেও আমরা হতাশ হলাম। ইংরেজিতে মাত্র কয়েক লাইনে ভারতের মধ্যযুগের প্রথম মুসলিম শাসক সুলতান রাজিয়ার পরিচয় দেয়া হয়েছে। ফলকেও দেখি সুলতানা রাজিয়ার পাশের কবরের পরিচয় অজ্ঞাত বলেই উল্লেখ করেছে।
Sultan Raziya’s Tomb শিরোনামে ফলকটিতে লেখা Earlier known as Rani Saji Ki Bargah this enclosure houses the grave said to be of Sultan Raziya who succeeded her father Sultan Iltutmish. She was able and valiant and was in authority from 1236-1240 A.D. , during which time she faced much opposition from her nobles. She … fighting on the 14th October 1240 A.D. at Kaithal in Karnal district in the course of a rebellion spearheaded by her own brother Muizzuddin Bahram Shah who succeeded her as sultan.
Of unpretentious architecture the enclosure preserves on a central platform, two graves of which the identity of the second is not known towards the south eastern corner are two other unknown graves. There is a Mihrab on the western wall of the undomed mausoleum.
ফলকটি পড়ার পর আমার ইতিহাস জ্ঞানের প্রতি স্যারের বিশ্বাস বেড়ে গেল। স্যার আমাকে বললেন তাহলে তোমাকেই আমরা গাইড মানছি। তুমি সুলতানা রাজিয়া নিয়ে আমাদের আরো কিছু বল। আমি বললাম স্যার আসলে ইতিহাসের ব্যাপারগুলোই এরকম। কেমন যেন মিথ জড়িয়ে ঘোলাটে করা হয়। সব শাসকই কমবেশি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন। সুলতানা রাজিয়াও তাই। ফলে ভাইয়ের হাতে প্রাণ দিতে হল। তবে দিল্লী বাসী তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। সুলতান হয়েই রাজিয়া সুন্দর করে গুছিয়ে নিলেন দিল্লী নগরীকে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। তাঁর নামে মুদ্রা জারী করেন। উপাধি নেন রাজিয়াত উদ দীন। সুলতানা রাজিয়ার জনপ্রিয়তা এবং রাজ্যের সমৃদ্ধিতে ঈর্ষার উদ্রেক করে অভিজাতদের। অভিজাতরা ধর্মকে টেনে আনেন। শুরু হয় ধর্ম বনাম রাজশক্তি। দেলোয়ার ভাই বললেন অভিজাতদের ঈর্ষার কারণ কি হতে পারে।
অভিজাততন্ত্র। সুলতানী আমলের ইতিহাসে অভিজাতরা অর্থাৎ আমীর ওমরাহরা ছিল খুবই ক্ষমতাশালী। এটি অবশ্য ইলতুতমিশের সময় থেকেই। এদেরকে চেহেলগানি বলা হতো। সুলতানা রাজিয়া তাদের ক্ষমতা খর্ব করেন। কিভাবে সেটাও বলছি।
এই অভিজাতরা ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভূত। তিনি তাদের বাইরে একজন অতুর্কী জামাল উদ্দীন ইয়াকুতকে উচ্চ পদে আসীন করেন। ব্যক্তিগত উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন। রাজকীয় আস্তাবলের প্রধানও তাকে করা হয়। এতে করে তুর্কীদের হাত থেকে রাজকীয় কমান্ড অতুর্কীর হাতে চলে যায়। ফলে সুলতানা রাজিয়ার প্রতি আমীর মালিকদের প্রতিহিংসা আরো বাড়তে থাকে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা রাজিয়ার সাথে ইয়াকুতের অবৈধ প্রণয় আছে বলে গুজবও রটিয়ে দেয়। কিন্তু দিল্লীর জনগণ রাজিয়ার পক্ষে ছিল। আসলামের আবারো জিজ্ঞাসা দিল্লীর জনগণ কেন রাজিয়াকে সমর্থন দেন।
ইলতুতমিশ মারা যাবার পর তুর্কী অভিজাতগনের বিরোধিতার কারণে সুলতানা রাজিয়া সিংহাসনে বসতে পারেন নি। তাঁর বদলে আমীর ওমরাহগণ তাঁর ভাই রুকন উদ দীনকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু রুকন উদ দীন দিল্লীর সুলতান হয়েই ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে যান। যেগুলো দিল্লী নগরবাসী স্বচক্ষে দেখেছেন। তাঁরা রুকন উদ দীনকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। এ সময়ে ইলতুতমিশের আরেক কনিষ্ঠ পুত্র গিয়াস উদ দীন অযোধ্যায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি লাখনৌতি থেকে দিল্লীতে যে ধন সম্পদ যাচ্ছিল তা নিজ অধিকারে নিয়ে নেন। ফলে রুকন উদ দীন বিদ্রোহ দমনের জন্য দিল্লী থেকে বের হন। এ সময়ে প্রাসাদেও ষড়যন্ত্র চলছিল। সুলতানা রাজিয়া দিল্লী নগরীতে জনতার সম্মুখে সুলতান রুকনউদদীন এবং মায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেন। দিল্লীর জনগন প্রাসাদ অবরোধ করেন। তাঁরা সুলতানা রাজিয়াকে সমর্থন দেন। সকাল থেকেই উৎকন্ঠার ছায়া নামলো রাজধানী জুড়ে। চওকের বাজার জামা মসজিদ বাজারে লোকে লোকারণ্য। প্রাসাদের বাইরে গোল গম্বুজ পার হয়ে জনতা ভিড় করেছে প্রাসাদের সম্মুখ দরজায়। আমীর ওমরাহদের অনেকেই জনসমর্থন দেখে ভড়কে যান। আবার অভিজাতদের মধ্য হতে অনেকেই সুলতানা রাজিয়ার পক্ষ নেন। ফলে রুকন উদ দীনকে অতি সহজেই বন্দী করা হয়। দিল্লী জুড়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। দিনে পাঁচবার করে জয়ঢাক বা নহবত বাজানো হলো। ইতিহাসের প্রথম মুসলিম মহিলা শাসক মসনদে বসলেন।
কিন্তু অভিজাতদের অনেকেই তখন থেকেই সুযোগ খুঁজছিলেন। কিভাবে সুলতানা রাজিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরানো যায়। আলতুনিয়াও এঁদের দলে ছিল। এদের কূটকৌশলের কাছে সুলতানা রাজিয়া হেরে গেলেন। আলতুনিয়াকে দিয়ে বিদ্রোহ করান অভিজাতরা। উদ্দেশ্য ছিল রাজিয়া দিল্লীর বাইরে গেলেই রাজধানী দখল করে নেয়া হবে। ঘটলেও তাই। কৌশলে আলতুনিয়াকে দিয়ে বিদ্রোহ ঘটিয়ে সুলতানা রাজিয়াকে দিল্লীর বাইরে পাঠানো হলো। আলতুনিয়ার সাথে যুদ্ধে সুলতানা রাজিয়া হেরে গেলেন এবং তাঁর হাতে বন্দী হলেন।
তাহলে দুজনেই আবার বিয়ে করলেন। বিষয়টা বুঝলাম না। অত্যন্ত পরিস্কার। দুজনেই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সুলতানা রাজিয়া আলতুনিয়ার হাতে বন্দী। তাঁর বেঁচে যাওয়া এবং দিল্লীর সিংহাসন ফিরে পেতে আলতুনিয়ার সাহায্যের দরকার ছিল। এদিকে যেসব আমীর এবং মালিকরা আলতুনিয়াকে দিয়ে বিদ্রোহ করান তারা রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে ফেলেন। সুলতানা রাজিয়ার ভাই বাহরামকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে আলতুনিয়া ও সুলতানা রাজিয়া দুইজনেই দিল্লীর দিকে রওয়ানা দেন এবং পথিমধ্যে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়নরত অবস্থায় মারা যান। এবং তার পরের ইতিহাস তো এখানেই। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সাদামাঠা এক কবরস্থানে।
শুধু তাই নয় প্রজা বিদ্রোহের ভয়ে তাঁর সমাধি স্থান গোপন রাখা হয়েছিল। জনশ্রুতি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল রাজিয়ার কবরস্থান উত্তরপ্রদেশের কোন এক অজ্ঞাত জায়গার কথা বলে। আমরা যখন ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছি। তখন প্রায় সন্ধ্যা আসন্ন। হঠাৎই আজিজ ভাই ব্যাগের ভিতর থেকে দুইটা মোমবাতি বের করলেন। আমরা বললাম আজিজ ভাই এ কি করছেন। গাইড রিজাউল সেখ বললেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললেন স্যার অনেকেই মোমবাতি জ্বালায়। ওই দেখুন গেটের সামনে মোমবাতি আর ধুপকাঠির দোকান। গাইড রিজাউল সেখের সাহায্যে আমরা হিসেব করে কয়েকটি ছবি নিলাম দেলোয়ার ভাইয়ের ক্যামেরায়। এরপর পা বাড়ালাম জামে মসজিদের উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে আরো একবার তাকালাম কবরগুলোর দিকে। দেখি মোমবাতি মিটিমিটি করে জ্বলছে আর গলে পড়ছে ভালোবেসে,শ্রদ্ধায়!
স্যারের দিকে তাকালাম দেখি স্যারও গুন গুন করে গাইছে রাজিয়া সুলতান সিনেমায় গাওয়া লতা মুঙ্গেশকরের সেই বিখ্যাত গানের কলি -এ্যাই দিলে নদন, এ্যাই দিলে নদন। আরুজ কিয়া হ্যায়, জসতু জি কিয়া হ্যায়। এ্যাই দিলে নদন, এ্যাই দিলে নদন। কিয়া কেয়ামত হ্যায়, কিয়া মুসিবত হ্যায় । কিয়া কিয়ামত হে, কিয়া মুসিবত হে ,কাহ নাহি সাকতে।
ড. মো আনোয়ারুল ইসলাম : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর-পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।