করোনায় গার্মেন্টসে সাফল্য

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মহামারীর মধ্যেই গত একটি বছরে সাড়ে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে না পারলেও দীর্ঘমেয়াদে বড় সুফল দেখছে বাংলাদেশ। সহজ করে বললে, মিয়ানমারে উত্তাল সামরিক পরিস্থিতি ও ভারতে অতিমারী করোনার কারণে প্রতিবেশী এ দুটি দেশ থেকে ক্রেতাদের রফতানি অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তর হচ্ছে। অবশ্য এর আগে থেকেই কিছু ক্রয়াদেশ চীন থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তর করে আসছেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। মহামারীর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে কারখানা সচল থাকায় আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের পোশাকের জন্য প্রচুর ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা। দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ কমায় অনেক ক্রেতাই আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ক্রয়াদেশ দিয়েছেন। কিন্তু ক্রমাগত পোশাকের দর কমে যাওয়া এবং প্রধান কাঁচামাল তুলার দাম এবং পরিবহনসহ ফ্রেইট খরচ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন রফতানিকারকরা।

তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর রফতানি কমতে থাকে ব্যাপকভাবে। সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশ থেকে মোট ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের (২ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা) পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রফতানি কমে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলার হয়েছিল। ওই অর্থবছরের শেষ তিন মাস মহামারীতে বিপর্যস্ত হলেও সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের পুরোটাই ছিল করোনাময়। তারপরও এই অর্থবছরে ভালো করেছে বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসের কঠিন পরিস্থিতিতেও তৈরি পোশাক রফতানির এমন চিত্রে আশাবাদী রফতানিকারকসহ সংশ্লিষ্টরা। পোশাক রফতানিকারকরা আগামী মাসগুলোতে ভালো রফতানির সম্ভাবনা দেখছেন। পোশাকশিল্প খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানালেন, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে। ফলে ওই সব দেশের ব্র্যান্ডগুলোর প্রত্যাশা, আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে পোশাক বিক্রি হবে। সে জন্য তারা প্রচুর ক্রয়াদেশ দিচ্ছে।

তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনা শাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। তার আগে থেকেই কিছু ক্রয়াদেশ চীন থেকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করে আসছেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় বর্তমানে ৫-১০ শতাংশ বেশি ক্রয়াদেশ আসছে। ফলে দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিক নিয়োগ বেড়েছে। এর বাইরে আরও কিছু ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে দেশের পোশাক খাত। এর মধ্যে একটি ইতিবাচক খবরও পেয়েছে পোশাকশিল্প। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ওয়াল্ট ডিজনি আবার এ দেশ থেকে পোশাক কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা সরিয়ে নেয়। তখন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশী কারখানা থেকে বছরে ৫০ কোটি ডলার বা ৪ হাজার কোটি টাকার পোশাক কিনত। এছাড়া রানা প্লাজা ধসের পর ক্রেতাদের তত্ত্বাবধানে ব্যয়বহুল সংস্কারের সুফলও পাচ্ছে বাংলাদেশ। স¤প্রতি নিরাপদ ও উন্নত পরিবেশে পোশাক উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক নৈতিক মান নিরীক্ষা (এথিক্যাল অডিট) সূচকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কোনো কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মান যাচাইয়ে এথিক্যাল অডিট পরিচালনা করে চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউআইএম। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোশাক কারখানার নিরাপদ পরিবেশ এবং সরবরাহ চেনে দায়িত্বশীলতা বিবেচনায় বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন প্রথম সারির।

বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘রফতানি আদেশ বাড়ছে। মূলত চীন, ভারত ও মিয়ানমার থেকে সরে আসা কিছু অর্ডার আমরা পাচ্ছি। এর সঙ্গে গত কয়েক বছরে তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে আমরা যে ঈর্ষণীয় উন্নতি করেছি, তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের আস্থা বাড়ছে। ফলে, ওয়াল্ট ডিজনির এর মতো প্রতিষ্ঠান আট বছর পর বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য আসার ঘোষণা দিয়েছে।’ অবশ্য রফতানি বাড়লেও এর সঙ্গে ক্রমাগত পোশাকের দাম কমে যাওয়া নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানান তিনি। বলেন, যে সব ক্রেতা নতুন করে বাংলাদেশের আসছে, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা করার সূচকে প্রত্যাশিত অগ্রগতি করতে না পারায় তাদের ধরে রাখা যাবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

ভারত ও মিয়ানমার থেকে রফতানি আদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তর সম্পর্কে বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যেসব ক্রেতা ও ব্র্যান্ড তার কাছ থেকে এবং একই সঙ্গে মিয়ানমার ও ভারত থেকে পণ্য নেন; তাদের কাছ থেকে এখন তিন গুণ রফতানি আদেশ পাচ্ছেন। ভারতের করোনার মারাত্মক পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের অশান্ত সামরিক পরিস্থিতির কারণে খুব স্বাভাবিক কারণেই ক্রেতারা ওই দুই দেশ থেকে কিছু অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছেন। কেননা, সময়মতো পণ্য বুঝে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। ফলে অতিরিক্ত যেসব রফতানি আদেশ তারা পাচ্ছেন, তার একটা অংশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে স্থানান্তর হয়ে এসেছে। তবে ভারত-মিয়ানমার থেকে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় কোন ক্রেতার কাছে কী সংখ্যক রফতানি আদেশ পাওয়া গেছে; ব্যবসার স্বার্থে সে তথ্য জানাতে চাননি তিনি। হান্নান গ্রুপের চেয়ারম্যান এবিএম শামসুদ্দিন বলেন, গত এক মাসে তার গ্রæপের কারখানাগুলোর রফতানি আদেশ হয়েছে তিন গুণ। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রেতা এখন বাংলাদেশে রফতানি আদেশ দিচ্ছে। পর্যাপ্ত রফতানি আদেশ থাকায় অনেক ক্রেতাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তারা। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় শতভাগ টিকা দেয়া শেষ হয়েছে। এ কারণে মার্কেট এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফ্লোর খুলে দিয়েছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের রফতানি আদেশ বেড়েছে। এ ছাড়া গ্রীষ্ম মৌসুমকে কেন্দ্র করে রফতানি আদেশ বেড়েছে।

ফতুল্লা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান এবং ইতাল অ্যাডওয়েজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরওয়ার আহম্মেদ জানিয়েছেন, সাধারণত জ্যাকেট আইটেমই বেশি করে মিয়ানমার। তাদের কারখানায় নতুন আসা রফতানি আদেশের একটা বড় অংশই জ্যাকেট। আগামীতে ভারত ও মিয়ানমার থেকে আরও রফতানি আদেশ আসবে বলে আশাবাদী তারা। তবে এদের কেউ ক্রেতার নাম উল্লেখ করতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, কিছু অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার পর উদ্যোক্তারা শিল্পকে পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ নেন। প্রায় এক দশক ধরে উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, কারখানার নিরাপত্তা খাতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় এবং সরকার, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান-উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন সারাবিশ্বে নিরাপদ শিল্পের রোল মডেল। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) ‘লিড প্লাটিনাম’ সনদ পেয়েছে দেশের ১৪৩টি পোশাক কারখানা। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি কারখানার মধ্যে ৩৯টিই বাংলাদেশের। এসবের সুফল পাচ্ছে পোশাক খাত। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সব শ্রমিকের জন্য টিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড বিশ্বখ্যাত অনেক ব্র্যান্ডের ডেনিম পোশাক প্রস্তুত করে। করোনার শুরুতে একাধিক ব্র্যান্ড সাময়িকভাবে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করলেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ পেয়েছে, তাতে আগামী মার্চ ও এপ্রিল পর্যন্ত দম ফেলার ফুরসত পাবেন না তাদের শ্রমিকেরা। বাড়তি ক্রয়াদেশের কারণে গত মাসে নতুন ২০০ শ্রমিক নিয়োগ করেছে ডেনিম এক্সপার্ট। আগামী মাসেও নতুন করে ২৫০-৩০০ শ্রমিক নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। জানতে চাইলে ডেনিম এক্সপার্টের এমডি মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি হওয়ায় সেখানকার ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে। কারণ, চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে আনছে অনেক ব্র্যান্ড।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের পোশাক আমদানির তথ্য সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ওটেক্সার তথ্যানুসারে, গত মে মাস পর্যন্ত ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই হার ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ।

এদিকে পোশাক বিক্রির আদেশ বাড়লেও চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার জট ও দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন রফতানিকারকেরা। কারণ, যে পরিমাণে পণ্য প্রস্তুত হচ্ছে, তা পরিবহনে কন্টেনার পাওয়া যাচ্ছে না। আবার জাহাজেও চাহিদা অনুযায়ী কন্টেনার পরিবহনের বুকিং মিলছে না। গত শনিবার পর্যন্ত ১৯টি ডিপোতে পণ্যবাহী কন্টেনার ছিল ১৩ হাজার ৫৬০টি। কন্টেনার বোঝাইয়ের অপেক্ষায় শেডে ও গাড়িতে ছিল আরও বিপুল পণ্য। বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘চলতি মাসে পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে কয়েক দিন কারখানা বন্ধ থাকবে। আশা করছি, আগস্ট থেকে পোশাক রফতানির পরিমাণ বেশ

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.