মাতারবাড়ী হবে জাপানের কিয়াসু দ্বীপ

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপ মহেশখালী-মাতারবাড়ী নিয়ে একটি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চাইছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা, যেটি বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ দরকার পড়বে। এর অর্ধেকের কিছু বেশি অর্থাৎ ১ হাজার ২৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার দিতে চাইছে জাইকা। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় জাইকার এই সমন্বিত উন্নয়ন প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হয়।

সূত্র জানায়, মহেশখালী-মাতারবাড়ীকে নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে জাপানের কিয়াসু দ্বীপের অভিজ্ঞতা নিয়ে। দেশকে শিল্পোন্নত করতে গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে জাপান যে ‘প্যাসিফিক বেল্ট’ নীতি গ্রহণ করে তারই উদ্যোগ হিসেবে দেশটির রাজধানী টোকিওর উত্তর দিক থেকে কিয়াসু দ্বীপের ওসাকা পর্যন্ত ১২০০ কিলোমিটার এলাকা শিল্পায়নের জন্য চিহ্নিত করে। যেটি বাস্তবায়নের পর

১০ বছরে জাপানের মাথাপিছু জাতীয় আয় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে ওই প্যাসিফিক বেল্টে ১০টি বড় আকারের অর্থনৈতিক জোন রয়েছে, যেখানে প্রায় ৫ লাখ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। দেশটির মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ আসে সেখান থেকে আর লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ওইসব কল-কারখানায়। কিয়াসু দ্বীপের ওই অভিজ্ঞতা থেকে এখন মহেশখালী-মাতারবাড়ীকে কেন্দ্র করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জোনে একই রকম অর্থনৈতিক হাব গড়ে তুলতে চাইছে জাইকা। সরকারি সূত্রগুলো জানায়, ২০১৯ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক প্রেজেন্টেশনে জাইকা মহেশখালী-মাতারবাড়ী নিয়ে সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়নে একটি মহাপরিকল্পনা তুলে ধরে। এটি বাস্তবায়নে তারা যে টাইমফ্রেম নির্ধারণ করেছিল, করোনা মহামারির কারণে সেটির কিছুটা পরিবর্তন করতে হবে।

এ ছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন ও বিজনেস মডেল দরকার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এখন এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) জুয়েনা আজিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় যে বিষয়গুলো উঠে আসে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-প্রস্তাবিত উন্নয়নযজ্ঞ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ (মিডি) গঠন ও একটি বিজনেস মডেল প্রণয়ন করা। শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে, মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ সংক্ষেপে মিডি নামে কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য দুই মাসের মধ্যে একটি খসড়া আইন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেবে এ সংক্রান্ত কমিটি। আর উন্নয়ন কার্যক্রমের বিজনেস মডেল প্রণয়নের জন্য একটি কারিগরি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

কী ছিল জাইকার প্রস্তাবে : জাইকা যে মহাপরিকল্পনাটি উপস্থাপন করেছিল, সেখানে তারা মহেশখালী ও মাতারবাড়ীকে নিয়ে একটি সমন্বিত উন্নয়নযজ্ঞ তিনটি ধাপে বাস্তবায়নের টাইমফ্রেম দিয়েছিল। যার মধ্যে প্রথম ধাপে ২০২৪ সালের মধ্যে ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল কোল পাওয়ারড বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কয়লা জেটি ও হারবার, ২০৩১ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বে গভীর সমুদ্রবন্দরের উপযোগী করে বন্দর সম্প্রসারণ ও এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ এবং তৃতীয় পর্বে ২০৪১ সালের মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, প্রাথমিক অ্যানার্জি সংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানা, পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলেছিল। জাইকা মাতারবাড়ীতে যে গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রস্তাব করছে, সেটির ড্রাফট হবে ১৮ দশমিক ৭ মিটার।

এত বেশি ড্রাফটসম্পন্ন গভীর সমুদ্রবন্দর বিশ্বে আর মাত্র দুটি রয়েছে। এর একটি শ্রীলঙ্কায় এবং অপরটি দুবাইয়ে। এর ফলে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টনের কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারবে ওই বন্দরে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে দীর্ঘমেয়াদে যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাব গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে জাইকা, ২০৪১ সাল শেষে সেই হাব থেকে ২১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। গড়ে তোলা হবে ৩ হাজার ৫০০ এমএমসিএফডি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এলএনজি টার্মিনাল। বন্দরভিত্তিক অর্থনৈতিক জোন সম্প্রসারণ করে সেটিতে ভারী ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হবে। আর ২০৪১ সালে তৃতীয় পর্বের কাজ শেষে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রায় ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা অর্জন করবে, যা হবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া ন্যাশনাল হাইওয়ে- ১ এবং রেললাইন স্থাপনের মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দর ও শিল্পহাবের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তোলা হবে, যা হবে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। উপরন্তু বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ বি ইনিশিয়েটিভ) গড়ে তোলার প্রয়াস রয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত এলাকা গড়ে তোলার লক্ষ্যও রয়েছে ওই মহাপরিকল্পনায়।

কত দূর এগোল মহাপরিকল্পনা : গত ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় মাতারবাড়ীর উন্নয়ন কার্যক্রম ও জাইকার প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হয়। সেখানে উপস্থাপিত তথ্য অনুসারে সমন্বিত উদ্যোগে মোট ৩৭টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১৫টি প্রকল্প জাপান সরকারের বিনিয়োগে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিকভাবে ৩৭টি প্রকল্প চিহ্নিত হলেও বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৪টিসহ মোট ৬৮টি প্রকল্প রয়েছে এই সমন্বিত উদ্যোগে। সব মিলিয়ে প্রায় ৭৮ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। আরও ৬টি প্রকল্পে নির্মাণ কাজ চলছে। বাকি প্রকল্পগুলোর কাজ ফিজিবিলিটি স্টাডি পর্যায়ে রয়েছে।

যেসব প্রকল্প শেষ হয়েছে সেগুলো হলো মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালী এফএসআরইউ প্রকল্প, মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন, মহেশখালী জিরো পয়েন্ট গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন এবং মাতারবাড়ী দ্বীপের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের প্রথম পর্যায়, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, মাতারবাড়ী-মধুনাঘাট ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ, মাতারবাড়ী বন্দরসংলগ্ন রোড এবং মাতারবাড়ী পাওয়ার প্লান্ট এক্সেস রোড নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহেশখালী-মাতারবাড়ীতে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছে, সেগুলোর কাজ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলছে। মহেশখালীতে হচ্ছে দেশের অ্যানার্জি হাব। মাতারবাড়ীতে নির্মাণ হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, সমুদ্রবন্দর ও ইকোনমিক জোন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতি নতুন মাত্রা পাবে।

 

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.