ঐতিহ্য ফিরেছে ইলিশের
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : লাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। আর এ ইলিশ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পদ্মার রুপালি ইলিশের চকচকে ছবি। রসনায় ও পুষ্টিগুণে ভরপুর ইলিশ বাংলাদেশের মৎস্য খাতের অন্যতম ফসল। ইলিশ উৎপাদনের সর্বশেষ তথ্যে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়-বর্তমানে বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশের সর্বোচ্চ আহরণমাত্রা সাত লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে আহরিত (৫.৫০ লাখ মে. টন) ইলিশের চেয়ে ১.৫০ লাখ মে. টন বেশি। অর্থাৎ বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে আরও ১.৫ লাখ মে. টন অতিরিক্ত ইলিশ সহনশীল মাত্রায় আহরণ করা যাবে। একইসঙ্গে ইলিশের মজুদ (Standing Biomasss) নিরূপণ করা হয়েছে তিন লাখ ৯৯ হাজার মে. টন। ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত গবেষণায় সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত এক যুগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৮%। বর্তমান সরকারের সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য ইলিশের পুরনো ঐতিহ্য ফিরে এসেছে। আগে কিছু কিছু ইলিশ আসত, যেগুলোর কোনো স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যেত না। কোনো অন্ধ ব্যক্তিকে দিলে তাকে এর নাম বলে দিতে হতো। এখন ইলিশে গন্ধ ফিরে এসেছে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এটা সম্ভব হয়েছে। আর এ ইলিশ মাছ ধরে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আলাদা দৃষ্টি আছে। আর তাই ইলিশ রক্ষায় আলাদা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যা মৎস্য খাতের অন্যতম বড় প্রকল্প। ইলিশবান্ধব বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের ফলে এখন শীতকালেও প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে।’ বিএফআরআই কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত ইলিশের মজুদ নিরূপণ গবেষণায় বাংলাদেশের সমুদ্রে সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থাৎ ১.৬২ লাখ মে. টন ইলিশ মজুদ আছে বলে জানা গেছে। এরপরেই মেঘনা (১.৫৮ লাখ মে. টন) এবং পদ্মা (৭৮.৫ হাজার মে. টন) নদীতে। মজুদের ওপর ভিত্তি করে সমুদ্রে ইলিশের সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন অর্থাৎ আহরণমাত্রা নিরূপণ করা হয়েছে তিন লাখ পাঁচ হাজার ৭৪৯ মে. টন, যা মেঘনা নদীতে দুই লাখ ৮৩ হাজার ২৬১ মে. টন এবং পদ্মা নদীতে ৮১ হাজার ৬৯৫ মে. টন। অর্থাৎ দেশের প্রধান দুটি নদী ও সমুদ্রে ইলিশের মোট মজুত হচ্ছে ৩.৯৯ লাখ মে. টন এবং সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন/আহরণমাত্রা হচ্ছে সাত লাখ মে. টন। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন ছিল ৬.০৯ লাখ মে. টন- যা ২০১৯-২০ এ সাত লাখ মে. টনে উন্নীত হয়েছে। এতে প্রতীয়মাণ হয় যে, দেশে ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইলিশের রিক্রুটমেন্ট ভালো হচ্ছে এবং উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইনস্টিটিউট থেকে পরিচালিত অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, গত বছর (২০২০-২১) ২২ দিন মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকার কারণে ৫১.৭৬% মা ইলিশ সম্পূর্ণভাবে ডিম ছেড়েছে। ফলে প্রায় ৪০ হাজার কোটি জাটকা নতুন করে ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে। গবেষকদের অভিমত, বর্তমান মজুদ নিয়ে আগামী দুই-তিন বছর সাত লাখ মে. টনের মধ্যেই ইলিশ আহরণ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এর বেশি মাছ আহরণ করা হলে ভবিষ্যতে ইলিশ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং ইলিশের প্রাকৃতিক মজুদ ও জাটকা উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে দেশে ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য। তাছাড়া, সমুদ্রে ২২ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকায় সমুদ্রে ইলিশের উৎপাদনও সাম্প্রতিককালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিএফআরআই থেকে পর পর দুই বছর (২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০) বরগুনা, পটুয়াখালী, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, মুন্সীগঞ্জ ও রাজশাহীর বিভিন্ন নদন্ডনদী ও সমুদ্রের ১২টি নমুনা স্থান থেকে লক্ষাধিক ইলিশ মাছের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে ৩৪-৩৬ সে.মি. আকারের ইলিশ এবং এদের অবদান ১৫-১৯%। অপরদিকে, সমুদ্রে ৩২-৩৪ সে.মি. সাইজের ইলিশ সর্বোচ্চ ২২% অবদান রেখেছে। এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষক ড. আশরাফুল আলম বলেন, ইলিশের সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন প্রতিবছরের বিদ্যমান মজুদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মজুদ কম-বেশি হলে আহরণমাত্রাতে পরিবর্তন হতে পারে। ইলিশ মাছের মজুদ জলাশয়ের গতি-প্রকৃতি, আহরণমাত্রা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সূত্রমতে, প্রতিবেদনে গবেষকগণ কতিপয় সুপারিশ প্রদান করেছেন। এগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান সুপারিশসমূহ হচ্ছে- বর্তমান মজুদের বিপরীতে দেশের নদ-নদী ও সাগর থেকে আগামী দুই-তিন বছর পর্যন্ত প্রতিবছর সাত লাখ মে. টনের বেশি ইলিশ আহরণ না করা, প্রতিটি ইলিশকে জীবনচক্রে কমপক্ষে একবার ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া, ইলিশের আহরণমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বজায় রাখার লক্ষ্যে ইলিশ ধরা জালের ফাঁসের আকার, নৌকার আকার, ধারণক্ষমতা ও নৌকাপ্রতি জনবলের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং ইলিশের বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্রকে দূষণের হাত থেকে সুরক্ষা করা।