দেশের পতাকা বিশ্বের বন্দরে, শত জাহাজের মাইলফলক এ বছরই

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : করোনা মহামারিকাল বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে বড় বিপর্যয় আনলেও কিছু শিল্প খাতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এ রকম একটি খাত হচ্ছে বাংলাদেশের জাহাজশিল্প। করোনাকালে বিশ্বজুড়ে পণ্য সরবরাহ কমে যাওয়ায় জাহাজ বিক্রির ধুম পড়েছিল। এতে দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়।

এ সুযোগ লুফে নিয়েছেন বাংলাদেশি শিল্প মালিকরা। তাঁরা একের পর এক জাহাজ কিনে নিজেদের বহরে যুক্ত করেছেন। আর এ কাজে সরকার নীতিগত, শুল্ককর কমানোসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দেওয়ায় জাহাজ কিনতে আর পেছনে তাকাতে হয়নি শিল্প গ্রুপগুলোর। এর সুফল দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট—আট মাসেই ১৮টি জাহাজ বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনের বহরে যুক্ত হয়েছে। আর এতেই বাংলাদেশি পতাকাবাহী মোট জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াল ৯০টি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ আরো অন্তত ১০টি জাহাজ যুক্ত হয়ে জাহাজের সংখ্যা ১০০ ছাড়ানোর আশা শিল্প মালিক ও নৌ বাণিজ্য দপ্তরের।

ক্রয় আরো বাড়বে : এরই মধ্যে সরকার জাহাজ কিনতে আরো উৎসাহ দিয়ে গত বাজেটে আগাম কর প্রত্যাহার, পুরনো জাহাজের আয়ুষ্কাল ২২ বছরের পরিবর্তে ২৫ বছর এবং আমদানির পর বিক্রয়ের সময়সীমা পাঁচ বছরের পরিবর্তে তিন বছর নির্ধারণ করে দেয়। এতে জাহাজ কেনা আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জানতে চাইলে কবির গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান বলেন, ‘নিজেদের প্রয়োজন ছাড়াও দেশি-বিদেশি পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত আছে আমাদের জাহাজগুলো। আমরা সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনকে ব্যবসা হিসেবেই নিয়েছি। এ জন্য দেশের মুদ্রা দেশেই থাকছে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিদেশে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে আমরা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছি। ’

এ বছরই ১০০ জাহাজ : সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৯০টি সমুদ্রগামী জাহাজ নিবন্ধন করেছে সরকারের নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৭টি খোলা পণ্যবাহী জাহাজ। ১৩টি ট্যাংকার, তিনটি গ্যাস পরিবহনকারী জাহাজ, ছয়টি কনটেইনার জাহাজ, একটি মাল্টিপারপাস জাহাজ আছে।

সমুদ্রগামী জাহাজ নিবন্ধন দেয় সরকারি সংস্থা নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তর। তাদের হিসাবে, ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যবসায়ীদের জাহাজ কেনা বাড়ছিল, তখন জাহাজের সংখ্যা ছিল ৬৭টি। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকেই হঠাৎ জাহাজ কেনা কমতে শুরু করে। কমতে কমতে ২০১৫ সালে ৪৭টিতে নামে। ২০১৬ সালে জাহাজের সংখ্যা নামে ৪৫টিতে, ২০১৭ সালে ৩৮টি এবং ২০১৮ সালে এর সংখ্যা ৩৭টিতে নামে। ২০১৯ সালে জাহাজ কেনার সংখ্যা আবার বেড়ে যায়। তখন জাহাজ বেড়ে ৪৭টিতে উন্নীত হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় করোনা মহামারি। ২০২০ সালে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে এক লাফে ৬৪টিতে উন্নীত হয় অর্থাৎ জাহাজ বাড়ে ১৪টি। ২০২১ সালে জাহাজের সংখ্যা আরো বেড়ে ৭৩টিতে উন্নীত হয় এবং সর্বশেষ ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এর সংখ্যা ৯০টিতে পৌঁছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড।

নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পের বিকাশে সরকারের দেওয়া সুবিধার আলোকেই মূলত শিল্পোদ্যোক্তারা জাহাজ কিনতে এগিয়ে এসেছেন। যেভাবে নিবন্ধিত হচ্ছে তাতে প্রতি মাসে একটি করে জাহাজ যোগ করবে মেঘনা গ্রুপ। আর এইচআর লাইনস যোগ করবে একসঙ্গে ছয়টি জাহাজ, যেগুলো চীনে তৈরি হচ্ছে। আরো কয়েকটি জাহাজ যুক্ত করার প্রক্রিয়ায় আছে। ২০২২ সালের শেষে জাহাজের সংখ্যা ১০০টিতে উন্নীত হবে বলে দৃঢ় আশা করছি।

কার কত জাহাজ : ৯০টি সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে শীর্ষে আছে কেএসআরএম স্টিল বা কবির গ্রুপ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মেঘনা গ্রুপের বহরে আছে ১৮টি জাহাজ। আকিজ গ্রুপের আছে ১০টি জাহাজ। এ ছাড়া সরকারি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) আছে আটটি, কর্ণফুলী গ্রুপের আছে ছয়টি, বসুন্ধরা গ্রুপের আছে ছয়টি, বিএসএ শিপিংয়ের তিনটি, এমআই সিমেন্টের তিনটি, ভ্যানগার্ড মেরিটাইমের দুটি, ডুরিয়া শিপিংয়ের দুটি, হানিফ মেরিটাইমের দুটি, ওরিয়ন গ্রুপের একটি, মবিল-যমুনা গ্রুপের একটি, পিএনএন শিপিংয়ের একটি, অ্যাডভান্সড শিপিংয়ের একটি, ডরিন শিপিংয়ের একটিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জাহাজ আছে।

বেশি জাহাজ কবির গ্রুপের : ৯০টি সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে ২৩টি জাহাজের মালিক চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপ। অর্থাৎ মোট জাহাজের প্রায় ২৬ শতাংশই কবির গ্রুপের। কেএসআরএম বা কবির গ্রুপের প্রথম ব্যবসা ছিল জাহাজ ভাঙা। কিন্তু জাহাজ ভাঙা পণ্যের পাশাপাশি ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল এবং নিজেদের সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়েই ২০০৩ সালে প্রথম জাহাজ ‘ফাতিমা জাহান’ কেনে কেএসআরএম। এর পর থেকে একে একে এখন ২৩টি জাহাজ তাদের বহরে যুক্ত হয়েছে।

এগিয়ে আসছে নতুনরাও : বড় শিল্প গ্রুপগুলোর জাহাজ কেনার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল নিজেদের কাঁচামাল নিজেদের জাহাজে পরিবহন করে অর্থ ও সময় সাশ্রয় করা। সেই উদ্দেশ্য পূরণে শিল্প গ্রুপগুলো পুরোপুরি সফল। এখনো প্রধানত গ্রুপগুলোর চাহিদা মেটাতেই জাহাজ কিনছে তারা। এর বাইরে ইদানীং নতুন প্রতিষ্ঠান বা ছোট প্রতিষ্ঠানও জাহাজ কিনে পণ্য পরিবহন করছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আগে কম থাকলেও গত তিন বছরে অন্তত আটটি হয়েছে। নৌ বাণিজ্য দপ্তরের তথ্যেই দেখা গেছে, দু-একটি করে জাহাজ কিনেছে এ রকম অন্তত ছয়টি নতুন প্রতিষ্ঠান আছে। পিএনএন শিপিংয়ের এমডি ক্যাপ্টেন শেখ সাহিকুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ জাহাজ পরিচালনায় অর্জিত অভিজ্ঞতা-দক্ষতা আমরা এখন সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনায় দিতে চাই। আশা করছি অন্য অনেকের চেয়ে আমরা ভালো করব। ’

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.