মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ দেশ সন্তুষ্ট
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, যথাসময়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আইনি বাধ্যবাধকতা, খালেদা জিয়ার দেশের বাইরে চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা, বিভিন্ন আইনি সংস্কারসহ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের নানা পদক্ষেপের বিষয়টি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। নারীর ক্ষমতায় ও সামাজিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে অংশ নেওয়া দেশগুলো।
গত ১৩ নভেম্বর সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির চতুর্থ ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) করা হয়েছে। কাউন্সিলে উত্থাপিত বাংলাদেশের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে অধিকাংশ দেশ। এমনকি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতির ধারাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এবারের কাউন্সিলে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সবাইকেই এখন পর্যন্ত তিনবার করে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এ মাসের ৬-১৭ নভেম্বরের সেশনে ১৪টি দেশকে চতুর্থবারের মতো পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।
এই কাউন্সিলে বৈঠকে অংশ নেওয়া দেশগুলো আগের বৈঠকের পরামর্শের কতটা প্রতিফলন দেশে ঘটাতে পেরেছে তা উপস্থাপন করে। সেইসঙ্গে দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও জবাবদিহিতা করতে হয়। এই কাউন্সিলে যে তিনটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে, তা জাতিসংঘ আগেই প্রকাশ করে দিয়েছিল। এবারের পুনর্মূল্যায়নে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। বৈঠক শেষে ভার্চুয়ালি সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, ৯০ শতাংশ দেশ বাংলাদেশের প্রশংসা এবং গঠনমূলক সমালোচনা করেছে। তিনি আরও জানান, শুধুমাত্র কানাডা ও সাইপ্রাস বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে বেশি সমালোচনা করেছে।
এবারের মানবাধিকার পরিষদের রেজোল্যুশন অনুযায়ী পেশকৃত বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিবেদন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তর দ্বারা প্রস্তুতকৃত তথ্যের সংকলন ও বাংলাদেশ বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের সারসংক্ষেপের ভিত্তি করে এটি পুনর্ম্যূলায়ন করা হয়।
বাংলাদেশের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে তৃতীয় মূল্যায়নের পর সাতটি সংস্থা মোট ১০ বার বাংলাদেশ সফর করেছে, যা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সময়ে বাংলাদেশের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ২০২২ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। কাউন্সিলে বাংলাদেশ উত্থাপন করে, ২০১৮ সালের পর থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বরাদ্দ ৯৯ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। সংস্থাটি তৃতীয় পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। বৈষম্য বিরোধী আইনের খসড়া সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে ২০২২ সালে এবং বর্তমানে পরীক্ষাধীন আছে।
এ ছাড়া নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম এবং লৈঙ্গিক সমতা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। শিশুদের আরও বেশি সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে শিশু আইন-২০১৩ সংশোধন করা হয়। ২০১৮ সালে ন্যূনতম চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির বাধ্যবাধকতা আছে। পরিত্যক্ত শিশুদের রক্ষা করার জন্য একটি আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন আছে। বাংলাদেশ জঘন্য অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-কে উপযুক্ত মনে করে। তবে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে মৃত্যুদণ্ডের প্রযোজ্যতা কমছে এবং পরিবর্তে জরিমানা ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্যাতন এবং কারাগারে মৃত্যু প্রতিরোধ আইন ২০১৩ এর অধীনে এখন পর্যন্ত ২৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। ২০২০ সালে ঢাকার একটি আদালত কারাগারে নির্যাতন করে এক ব্যক্তিকে হত্যা করায় তিনজন পুলিশ অফিসারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
বাংলাদেশের সংবিধান ৩৯ নং অনুচ্ছেদের অধীনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জন্য কোনো সেন্সরশিপ ব্যবস্থা নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর অস্পষ্ট সেকশন-৫৭ বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ তে আরও নির্দিষ্ট বিধান দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রণীত হয়েছে, বাক-স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা বা গণমাধ্যমকে হয়রানি করা এর উদ্দেশ্য নয়।
বাংলাদেশ সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তহবিল এবং জনবলের অভাবের কারণে মামলার ক্রমবর্ধমান ব্যাকলগ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। বিচার বিভাগীয় মনিটরিং ড্যাশবোর্ড, অনলাইন কজ লিস্ট, মাইকোর্ট মোবাইল এপ ইত্যাদি প্রবর্তন করা হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ শতাংশে। সরকার ই-জুডিসিয়ারি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
সব ধরনের অপহরণ এবং অপহরণ সংক্রান্ত অপরাধ পেনাল কোডের ৩৬৩ থেকে ৩৬৯ ধারার আওতায় রয়েছে। এই আইন প্রণয়নকারী সংস্থার সকলের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। আইন প্রণয়নকারী সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৬৯২টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আট হাজার ৪৮৮ জন পুলিশ সদস্যকে বড় ধরনের শাস্তি এবং এক লাখ আট হাজার ৮৩৩ জন সদস্যকে ছোটখাটো শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ ও হত্যায় জড়িত থাকার কারণে তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ২৫ জন র্যাব কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় (এর মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যুদ-)। ২০২২ সালে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও তার কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের মামলায় সাত ডিবি সদস্যকে ১২ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে একটি চেকপোস্টে রাশেদ খান সিনহাকে হত্যা করায় দুই পুলিশ অফিসারকে মৃত্যুদ- এবং ছয় অফিসারকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে।
ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসএপেয়ারেন্স ৭৬ জন বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তির তালিকা প্রেরণ করেছিল। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে এ বিষয়ে দুটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ৯ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। দুজন বিদেশী নাগরিক যাদের গুমের ব্যাপারে কোনো বিচারিক বা পুলিশ রেকর্ড নেই, ২৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মামলা আছে এবং তারা শাস্তি থেকে বাঁচতে পালিয়ে আছে, ১০টি কেসের ব্যাপারে গুম হওয়া লোকদের আত্মীয়রা তদন্তে সহায়তা করেনি এবং ২৭টি মামলা তদন্তাধীন আছে।
১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দিয়েছে। কক্সবাজারে তাদের জন্য নির্মিত অস্থায়ী বাসস্থানে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় এবং জীবনযাত্রার মানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানোতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য তাদের আশ্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন নিশ্চিত করছে
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ। রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য ২৫ শতাংশ বরাদ্দ এবং অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ কোটা বরাদ্দ আছে। এ ছাড়া কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (চাকমা, মারমা, গারো এবং সাদরি) তে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় নিজ নিজ মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে পাচ্ছে। সরকারি, আধা-সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য চাকরিক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ কোটা বরাদ্দ আছে। তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং প্রচারে সরকার ১০টি গবেষণা ও সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশের উত্থাপিত প্রতিবেদনের বিপরীতে জাতিসংঘ ও স্টেকহোল্ডারও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের দেশ সফরের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। সেইসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আরও স্বাধীন করা এবং বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশও করা হয়েছে। একইসঙ্গে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার স্থগিত করা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, অক্ষমতা, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়ে বর্তমান বৈষম্য বিরোধী খসড়া আইনে দুর্বলতাও সংস্থাগুলো উল্লেখ করেছিল।
এ ছাড়া শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- প্রয়োগের ওপর স্থগিতাদেশ এবং মৃত্যুদ- কমিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বলপূর্বক গুম বিষয়ে উদ্বেগও প্রকাশ। একটি স্বাধীন সংস্থা গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে যারা এ বিষয়ে তদন্ত করবে। কারাগারের অভ্যন্তরে নির্যাতন ও মৃত্যু বিষয়ে উদ্বেগ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা। রোহিঙ্গা ইস্যু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইস্যু- এ রকম বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ আছে প্রতিবেদনগুলোতে।
কাউন্সিল শেষে আইনমন্ত্রী সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, বাংলাদেশের উত্থাপিত প্রতিবেদনে অনেক সমালোচনাকারী দেশও সন্তোষ জানিয়েছে। এ ছাড়া একটি দেশের প্রশ্নের বিপরীতে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের আইনি বাধ্যবাধকতাসহ অন্যান্য খাতের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ধারাটি তুলে ধরা হয়েছে।