মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর সরকার

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনী ইশতেহার ও সরকার গঠনের পর নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। আসন্ন রমজান ছাড়াও বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে। বিশেষ করে অবৈধভাবে পণ্যের মজুতদারির বিরুদ্ধে বারবার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে সারা দেশে কৃষি, খাদ্য, প্রাণিসম্পদ, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জনগণকে মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, যারা পণ্য মজুত করে দাম বাড়ায়, তাদের গণধোলাই দেওয়া উচিত।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম কালবেলাকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আমরা শতভাগ একমত। বুধবার (আগামীকাল) এ-সংক্রান্ত একটি সভা আহ্বান করেছি। সেখান থেকে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদেরও একটি ঘোষণা থাকবে। যারা অযৌক্তিভাবে পণ্যের দাম বাড়ায়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তারা মোট ব্যবসায়ীর মধ্যে ১ শতাংশেরও কম। এসব ব্যক্তি এবং চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে আমরা অনুরোধ করব। কারণ, তথাকথিত এসব ব্যবসায়ীর জন্য সব ব্যবসায়ীর বদনাম হতে দিতে পারি না।

নিত্যপণ্যের বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বাড়ে। দেশে পণ্য বিপণন প্রক্রিয়ায় আমদানিকারক বা প্রক্রিয়াজাতকারী, ফড়িয়া, বেপারী, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ী হয়ে ভোক্তার হাতে পণ্যে আসে। আর এ সময়ের মধ্যে কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দিলে বাজারে সংকট তৈরি হয় এবং পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এ বছর এসব খাতেই বিশেষ তদারকির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

জানা গেছে, চাল, আলু, পেঁয়াজ, ডিম, মুরগি, মাছ, মাংস, শাকসবজিতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। এসব পণ্যের আমদানি করতে হয় না। তবে কোনো কোনো বছর উৎপাদন ও সংরক্ষণ সমস্যার কারণে ঘাটতি দেখা দিলে পেঁয়াজ ও আলু আমদানি করতে হয়। প্রয়োজনে চালও আমদানি করা হয়। এ ছাড়া ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, গম, মসলা, ছোলা, দুধ, শিশুখাদ্য, খেজুরের মতো পণ্য আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। তবে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা পণ্যের অবৈধ মজুত গড়ে তোলে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। ফলে বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়ে যায়; ভোক্তাকে অযৌক্তিক মূল্যে নিত্যপণ্য কিনতে হয়। এ নিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণে সরকার বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নিলেও তার সুফল ভোক্তারা পাচ্ছেন না। এ কারণে এবার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে জনস্বার্থে নিত্যপণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে এবং সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জনগণকে মজুতদারদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে বলা হচ্ছে।

বাজার পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে আমদানি সংশ্লিষ্ট শুল্ক বন্দরে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মশুর ডাল ও খেজুর দ্রুত খালাসের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে পণ্য পরিবহনে যেন বাধা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের জননিরাপত্তা বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, পুলিশ অধিদপ্তর ও নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রমজান উপলক্ষে ভোক্তাদের একসঙ্গে অধিক পণ্য না কেনার বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ২০২৩ সালের ৫ জুলাই খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের উত্থাপিত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন-২০২৩ জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে। পাস হওয়া বিলে বলা হয়, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের অধিক পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুত করলে বা মজুত-সংক্রান্ত সরকারের কোনো নির্দেশনা অমান্য করলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। অপরাধটি হবে জামিন অযোগ্য। খাদ্যদ্রব্য বলতে যে কোনো ধরনের দানাদার খাদ্যদ্রব্য অর্থাৎ চাল, ধান, গম, আটা, ভুট্টা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। যদি প্রমাণ হয় যে, মজুতদার কোনো লাভের জন্য পণ্য মজুত করেনি, তাহলে ৩ মাসের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছি। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধেও কাজ করছি। রমজান উপলক্ষে অবৈধভাবে যারা নিত্যপণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, পণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়া বা কমার সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক খুব একটা নেই। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সেজন্য আমরা পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে চাই। সে লক্ষ্যে কাজ করছি। সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কাজ করতে সরকারের অসহায়ত্ব বোধ রয়েছে—এটা দেখতে চাই না। পণ্য সরবরাহে যারা আছেন, সেখানে কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরবরাহ ব্যবস্থার গোড়ায় অভিযান চালানো হবে। এ ছাড়া কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং চলবে, অবৈধ মজুতদারিকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে সাধারণ ব্যবসায়ীরা যাতে হয়রানি না হন, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে চড়া দামে পণ্যটি কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। গত বছর এ সময়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪০ টাকা বিক্রি হলেও এ বছর বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকার বেশি দামে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার অন্য বছরের নিয়ম ভেঙে প্রতিবেশী দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে, যা আগামী সপ্তাহে বাজারে আসবে। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারের এ উদ্যোগে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কমে আসবে।

আমাদের দেশের ১৫টি জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন বেশি। সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী জেলা হলো পাবনা। বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে পাবনায় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি ও আলহাজ আব্দুর রাজ্জাক অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মো. ফোরকান রেজা বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, এ অঞ্চলে পেঁয়াজের ফলন ভালো। মোট চাহিদার অনেকাংশ এখান থেকে সরবরাহ হয়। তবে কোনো ব্যবসায়ী যাতে সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা করতে না পারে, সেজন্য চেম্বার সভাপতি ও স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে নিয়মিত তদারকি চলে। সামনে রমজান, সেজন্য আমরা বেশি সচেতন। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমিতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় সভা ও মতবিনিময় হচ্ছে। আশা করছি, মজুতদারির কারণে পাবনা থেকে কোনো সংকট হবে না। তবে তদারকির নামে ব্যবসায়ীরা যাতে কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে প্রশাসনকে খেয়াল রাখত হবে। আর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে রাজনৈতিকভাবে যাদের কথা বলা হচ্ছে, আমাদের এখানে (পাবনায়) তাদের কোনো কার্যক্রম বা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

পেঁয়াজের মতোই মাছ-মাংস, ডিম-মুরগির সরবরাহ সমস্যার কারণে বাজারে সংকট তৈরি হয়। এ বছরও রোজার আগেই ডিম ও মুরগির দাম বেড়েছে। গরুর মাংসের কেজি হাড়সহ ৭৫০ টাকা এবং হাড়ছাড়া ৮০০ বা তারও বেশি দামে বেক্রি হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পোলট্রি খাত-সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক খামারিদের দাবি, বড় ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থাপনা এবং পোলট্রি পণ্য পরিবহণে সড়কে চাঁদাবাজির জন্য ডিম-মরগির দাম বাড়ছে। বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির কেজি ২২০ থেকে ২৩০ টাকা এবং প্রতি হালি ডিম ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, করপোরেট গ্রুপের ডিম-মুরগি, পোলট্রি ফিড, মুরগির বাচ্চা পরিবহনে বিআরটিএর অনুমতি থাকলেও প্রান্তিক খামারিদের তা নেই। তাই রাস্তায় চলাচলে ট্রাফিক বিভাগ, হাইওয়ে পুলিশ, থানার চেকপোস্টসহ সারা দেশের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রতিমাসে চাঁদা দিয়ে আমাদের চলতে হয়। এ ছাড়া পোলট্রি পরিবহন রাতে চলাচলে বাধ্য থাকায় ডাকাতি ও ছিনতাইর কবলে পড়ে। এতে ডিম ও মুরগি পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। এরই ধারবাহিকতায় দামও বাড়ে। পাশাপাশি রমজানের আগে ডিম-মুরগির দাম বাড়ার পেছনে বড় উদ্যোক্তা বা করপোরেট প্রতিষ্ঠান জড়িত বলেও তিনি দাবি করেন। তার মতে, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা জড়িত থাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.