বিষমুক্ত সবজি বিপ্লবের হাতছানি

চাহিদার পাশাপাশি আবাদও বাড়ছে

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মুজিব শতবর্ষে পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর শুরু করেছে নিরাপদ সবজির উৎপাদন। ক্রেতাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে দেশে ক্রমেই বাড়ছে এই বিষমুক্ত নিরাপদ সবজির চাষাবাদ। কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজির বাজারও। দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে সবাই এখন স্বাস্থ্য ও খাদ্য সচেতন। বর্তমানে সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ। প্রতি বছরই বাড়ছে সবজি চাষের জমির পরিমাণ, বাড়ছে ফলনও। এখন কেমিক্যাল ছাড়া কতটা বিষমুক্ত করে উৎপাদন করা যায় সেদিকেই নজর দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ভোক্তা পর্যায়েও দিন দিন বিষমুক্ত সবজির চাহিদা বাড়ছে বলে চাষীরাও আবাদ বৃদ্ধি করছেন। সরকারের নজরদারিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ ও বর্তমান ধারাবাহিকতা থাকলে দেশে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনেও এক সময় বিপ্লব ঘটে যাবে।

দেশে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর সবজি আবাদের জমির পরিমাণ বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে ফলনও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্যে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে যেখানে ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৮২৭ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন হতো ১ কোটি ৯৩ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৫ মেট্টিক টন। সেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ২ কোটি ৮৯ লাখ ২২৩১ মেট্টিক টন সবজি। অর্থাৎ শুধু সাত বছরে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫২ হেক্টর জমি বেড়েছে সবজি আবাদে। আর একই সময়ে ৯৫ লাখ মেট্টিক টন ফলন বেড়েছে।

জানা যায়, বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্ববাজারে অর্গানিক (জৈব) সবজি ও ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দামও তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাড়ছে উৎপাদন খরচ। দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি ও বাতাস। দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এসব সমস্যা থেকে কৃষক ও পরিবেশকে বাঁচাতে দেশে প্রথমবারের মতো ১০ উপজেলার ১০ ইউনিয়নকে মডেল হিসেবে নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আইপিএম প্রকল্পের আওতায় ১০০ একর করে মোট এক হাজার একর জমিতে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি চাষ হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মোঃ আসাদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের কৃষকরা অনেকেই আবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন কীটনাশক দিয়ে থাকেন। কীটনাশক না দিয়ে যাতে সবজি উৎপাদন করতে পারেন কৃষক এবং আমরা যাতে নিরাপদ খাদ্য পেতে পারি সেভাবেই কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আর নিরাপদ সবজির চাহিদাও বাড়ছে বাজারে। একটু বেশি দাম হলেও ক্রেতাদের অনেক আগ্রহ এই নিরাপদ বিষমুক্ত সবজির প্রতি। তাই আইপিএম মডেল ইউনিয়নের মাধ্যমে সবজিচাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে দেশের ১০ উপজেলার ১০ ইউনিয়নে ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’ হিসেবে বিষমুক্ত সবজি চাষ শুরু হয়। রবির ফলন শেষে গ্রীষ্মকালীন সবজির প্রস্তুতি নিচ্ছে কোথাও কোথাও। এছাড়াও আগামী মৌসুমে আরও ১০ উপজেলার ১০ ইউনিয়নে এই উদ্যোগ নেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষমুক্ত সবজির চাহিদা দেশজুড়ে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চাহিদা বাড়ছে বিষমুক্ত সবজির। ইতোমধ্যে যশোর এবং বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’র চাষকৃত বাঁধাকপি রফতানি শুরু হয়েছে। আরও কয়েকটি মডেল ইউনিয়নের বিষমুক্ত সবজি রফতানির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’-এ বিষমুক্ত সবজিচাষ করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, প্রকল্পের অধীন দেশের ১০ উপজেলায় আইপিএম মডেল ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি আইপিএম মডেল ইউনিয়নের ২৫টি দলে আটজন নারীসহ ২০ জন করে কিষান-কিষানি সমন্বয়ে ৫০০ কিষান-কিষানি ১০০ একর জমিতে জৈব কৃষি ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে রবি মৌসুমের সবজি উৎপাদন করছেন। সবজির মধ্যে রয়েছে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, শশা, লাউ, মরিচ ইত্যাদি। প্রকল্পভুক্ত এসব সবজি খেতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ভার্মি কম্পোস্ট। ক্ষতিকর পোকা-মাকড় দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঠালো ফাঁদ, নেট হাউস, জৈব বালাইনাশক, ইকোমেকস, বায়োট্রিন ইত্যাদি।

প্রকল্পভুক্ত কৃষকদের বিনামূল্যে সবজির চারা উৎপাদনের জন্য বীজ, কেঁচো সার, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নগদ অর্থ দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এসব ব্যবহার পদ্ধতির ওপর কিষান-কিষানিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শেখানো হয়েছে ফাঁদ স্থাপনের কায়দা-কৌশল।

প্রকল্পভুক্ত ১০টি ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’ হচ্ছে- যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়ন, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়ন, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ, শেরপুরের লালিতা বাড়ি উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার মুশুদ্দি ইউনিয়ন, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলিয়া ইউনিয়ন, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সাতোর ইউনিয়ন, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকু-া ইউনিয়ন, ঢাকার ধামরাই উপজেলার ছানুরা ইউনিয়ন এবং রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়ন।

পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক আহসানুল হক চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আমার প্রকল্পের মেয়াদে ২০ ইউনিয়নে এই নিরাপদ সবজির করার জন্য মডেল ইউনিয়ন নির্বাহন করা হবে। যেখানে চাষ হবে সম্পূর্ণ নিরাপদ সবজি। এ বছর ১০ উপজেলার ১০ ইউনিয়ন নির্বাচন করা হয়েছে। আগামী বছর আরও ১০ ইউনিয়ন নির্বাচন করা হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে পরীক্ষামূলকভাবে এই ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’র কর্মসূচীগুলোকে কর্তৃপক্ষ মনে করলে হয়ত ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। রবি, খরিপ-১, খরিপ-২ এই তিন সিজনে এখানে আমরা দেখভাল করব কৃষকদের সহায়তা দেব। এরই মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’ পরিদর্শন করেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মেসবাহুল ইসলাম এবং কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় পরিদর্শন করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ আসাদুল্লাহ। তারা বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন।

বাঁধাকপি যাচ্ছে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে ॥ ১০টি ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’র মধ্যে যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নও রয়েছে। স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, আমাদের কাছ থেকে বাঁধাকপি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে রফতানি হয়েছে। ৫০০ মেট্টিক টনের চাহিদা থাকলেও আমরা এখন পর্যন্ত ৬২১ মেট্টিক টন পাঠিয়েছি। আমাদের দেশে যেমন বিষমুক্ত সবজির চাহিদা বেশি, তেমনি বিদেশেও যারা নিচ্ছেন তারাও বিষমুক্ত সবজিই চাচ্ছেন। সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক ও জাগরণী ফাউন্ডেশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঁধাকপি রফতানি হচ্ছে। মডেল ইউনিয়ন থেকে ২০০ মেট্টিক টন বাঁধাকপি দেয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিটা উপজেলার অন্য এলাকা থেকে দেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের ১০০ একর জমিতে প্রজেক্টের আওতায় প্রদর্শনী করা হয়েছে। এই প্রদর্শনীর বাইরে এই ইউনিয়নে ব্যক্তি উদ্যোগে আরও প্রায় ৩০০ একরেরও বেশি জমিতে বাঁধাকপি চাষ হয়েছে। পুরো যশোর সদর উপজেলায় প্রায় তিন হাজার একর জমিতে বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ অন্যান্য সবজি চাষ হয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার তথ্য মতে, স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এটি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। স্থানীয় বাজারেও কৃষকরা বেশ ভাল দাম পেয়েছেন। আর যারা মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের বায়ারদের কাছে বিক্রি করেছেন সেখানে প্রতি পিসে দাম বেশি পেয়েছেন ৩ টাকার মতো। এছাড়াও লাউ পটলের চাহিদা আছে যা দ্রুতই বিদেশে যাবে বলেও জানান তিনি। তবে বিদেশে বেশি পরিমাণে চাহিদা থাকলেও অনেক সময় সরবরাহ করা যায় না যদি তা পুরোপুরি নিরাপদ না হয় বলেন যশোর সদরের এই কৃষি কর্মকর্তা।

যশোরের মতো বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকেও বাঁধাকপি রফতানি হয়েছে বিদেশে। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আল মুজাহিদ সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, উপজেলার আইপিএম মডেল দেউলিয়া ইউনিয়নসহ উপজেলায় রবি মৌসুমে মোট এক হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। শিবগঞ্জ থেকে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় বাঁধাকপি রফতানি হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত ৮৫০ টন বাঁধাকপি রফতানি হয়েছে। এছাড়া কয়েক শ’ টন মিষ্টি কুমড়ার চাহিদা রয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। মডেল ইউনিয়নের বিষমুক্ত মিষ্টি কুমড়াও রফতানি করা হবে বলে জানান তিনি।

ঢাকায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে প্রতি শুক্র ও শনিবার কৃষকের বাজার এবং স্থানীয় বাজারে এ বিষমুক্ত সবজি সরাসরি বিক্রি করছেন কৃষক। রাজশাহীর পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা জানান, উপজেলার পারিলা ইউনিয়নে মডেল হিসেবে এক শ’ একর জমিতে জৈব সার দিয়ে সবজি চাষ হয়েছে। এছাড়া এ উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে প্রায় ২ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। বিদেশে সব সময় আছে নিরাপদ সবজির বাজার সেই সঙ্গে বর্তমানে দেশের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। কৃষক ভোক্তাদের আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারও এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে ঠিক পরিকল্পনা আর কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে সারাদেশেই হবে নিরাপদ সবজি চাষ।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.