বঙ্গবন্ধু: ভেঙ্গেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোর্তিময় । মোহীত উল আলম

0

বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে এর পিতা বঙ্গবন্ধুর ১০১ বছর শুরু হলো। আর আজকে এ লেখাটার দিন ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের সুবর্ণ জয়ন্তী। এমন মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধুর জীবনটা নিয়ে ভাবলে, ফলাফলটা শুধু হয় এক ব্যতিক্রমী বিষ্ময়। তাঁর লক্ষ্য ছিল তাঁর সময়কার পৃথিবীর দরীদ্রতম জনগোষ্ঠীকে একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে যাওয়া। তিনি দিলেনও।

বঙ্গবন্ধুর সাফল্য তাঁকে ‘রাজনীতির কবি’ অভিধা এনে দিয়েছে। এই অভিধাটার একটু সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যই আজকের লেখাটা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্ষুরধার সমালোচক-সাহিত্যিক স্যামুয়েল জনসন ইংরেজী ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, অন্য লেখকেরা রাজা, রানির চরিত্র এঁকেছেন, কিন্তু শেক্সপিয়ার এঁকেছেন মানুষের চরিত্র। রাজা হলেও একজন লোক মাতাল হতে পারেন, সে জন্য সে রাজাকে শেক্সপিয়ার মাতাল-রাজা হিসেবে এঁকেছেন। এই মন্তব্যের তাৎপর্য হলো, মানুষকে পদ-পদবী দিয়ে নয়, চিনতে হয় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে।

মানুষ চেনার পথে ধাবিত হলে ব্যক্তির বাহ্যিক পরিচিতি গৌণ হয়ে পড়ে। জীবনপথে বঙ্গবন্ধুর পরিক্রমণ ঠিক এ নীতিই অনুসরণ করেছিলো দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ মানুষ কোনটা সৎ, কোনটা ভেজাল, কোনটা আপসকামী, কোনটা প্রতিবিপ্লবী, কোনটা অতিবিপ্লবী, এবং কোনটা প্রকৃত বিপ্লবী–এ ধারণাগুলো বঙ্গবন্ধুর কত পরিষ্কার ছিল তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা পড়লে সম্যক ধারণা হয়।
অর্থাৎ বাইরের খোলস নিয়ে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বতার তলায় আসল কাজটি কী সেটি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যখন পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর পরই তাঁর উপলব্ধি হয় যে বাঙালি কড়াই থেকে আগুনে পড়েছে–তাই আন্দোলন নতুনভাবে শুরু করতে হবে। ১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগের একটি সম্মেলনে বলেছিলেন, “যতদূর মনে পড়ে, ১৯৪৭ কলকাতার পার্ক রোডের সিরাজ-উদ-দ্দৌলা হোস্টেলে একটা ঘরোয়া বৈঠক করি। সেখানে আমার সহকর্মী কয়েকজন ছাত্রনেতাকে বলেছিলাম, ‘আমরা শেষ হয়ে গেছি। নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে’”।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়টা প্রথম তুঙ্গে ওঠে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবি পেশ করার পর পরই। বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কারাগারে। কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থের ১৪ জুন ১৯৬৬ সালের রোজনামচায় বলছেন, “৬ দফা দাবি পেশ করার সাথে সাথে দুনিয়া জানতে পেরেছে বাঙালিদের আঘাত কোথায়?”

বাঙালিদের আঘাতের জায়গার কেন্দ্রবিন্দু চিহ্নিত করার অর্থ পাকিস্তানের অপশাসনের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পারা। এই জায়গায় সেটি সম্ভব হলো যার কারণ আমি ওপরে ব্যাখ্যা করেছি, অর্থাৎ পদ-পদবী দিয়ে নয়, ক্ষমতার দম্ভ দিয়ে নয়, বঙ্গবন্ধু আইয়ুব শাসনের ভিতরের শয়তানি চরিত্রটা বুঝতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ, তৎকালীন বিশ^স্বীকৃত লৌহমানব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যে একজন দুর্বিনীত অত্যাচারী সেনাশাসক বৈ আর কিছু নয়, বঙ্গবন্ধু সেটি বুঝলেন যখন দেখলেন যে ধর্মের লেবাসটি পাকিস্তানের প্রশাসক গোষ্ঠী একটি শোষণ-বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। এই শোষণের বিরুদ্ধে পেশ হলো ৬ দফা দাবি। তিনি ভবিষ্যৎকে দৃষ্ট করে বললেন, “পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিত–শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা আছে।” তারপর লিখছেন, “বাঙালির একটা গোঁ আছে, যে জিনিষ একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণও করতে পারে।”

ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক রল নক্স ’ইস্ট পাকিস্তানস কেইস’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ছেপেছেন ৭ জুন ১৯৬৬ সালে, সেটি পড়ে বঙ্গবন্ধু ঐ একই এন্ট্রিতে লিখলেন যে রল নক্স একটি সত্য কথা লিখেছেন যে (উদ্ধৃতিটার আমি বাংলায় ভাষান্তর করছি) “যদি রাওয়ালপিন্ডি মনে করতে থাকে যে বাঙালির বিপ্লবী সত্তা একটা কৌতুক ছাড়া আর কিছু নয়, তা হলে পাকিস্তানের কর্র্তৃপক্ষ একটি ভালোই প্রমাদ করছেন।”
পাকিস্তানের প্রশাসনিক কাঠামোর অচলায়তনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা শুধু বাঙালি জাতির নয় শোষিত মানবতার মুক্তির সনদ ছিল। এটি সম্ভব হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেক্সপিয়ারের মতোই ঐ ভিতরের মানুষটাকে চিনেছিলেন বলে। তিনি না একটি ভাষণে বলেছিলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব চান না, তিনি বাংলার জনগণের মুক্তি চান। এটি শুধু রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না, এটি ছিলো তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস।
নির্যাতিত বাঙালির জন্য একটি দেশের জন্ম দেওয়ার চিন্তাটা কেবলমাত্র রাজনৈতিক বীক্ষা থেকে সৃজিত হতে পারে না। এটার জন্য লাগে মানুষের চরিত্রের মূল প্রবণতার সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করে তোলার, যে ক্ষমতাটি বড় সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রায় বিধিপ্রদত্ত। আমি এই কথার অনুসরণে বলতে চাই যে বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এই সাহিত্যিক গুণাবলী ছিলো। মানুষের চরিত্র বয়ানের সময় এর মধ্যে নিহিত যে কৌতুককর অবলোকনটি থাকে, তাও দেখছি পুরোমাত্রায় উপস্থিত ছিলো বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায়।

মানুষ মাত্রই কর্তৃত্বপরায়ন, তার পদপদবী যাই হোক না কেন। কারাগারের রোজনামচায় এই প্রবণতাটির উপস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সকৌতুক বর্ণনাটি শুনুন: “একটা সত্য ঘটনা না লিখে পারছি না। ঘটনাটা ঢাকা জেলে ঘটেছিল। একজন কয়েদির কয়েকটা চুরি মামলায় কয়েক বছর জেল হয়। চোর বলে গ্রামের লোক ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় এবং জেল দেওয়াইয়া দেয়।” একসময় লোকটা মেট হয়, মেট হয়ে সে কিছু কয়েদির ওপর কর্তৃত্ব করার ভার পায়। তখন সে স্ত্রীকে জেল থেকে এক চিঠি দেয়। বঙ্গবন্ধু লোকটির চিঠির বয়ান শুনেছিলেন একজন জেলারের কাছে। তারই বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন: “‘গ্রামে আমার কথা কেহই শুনতো না, আমাকে সকলে ঘৃণা করত, কিন্তু খোদার মেহেরবানিতে জেলখানায় আমার এত প্রতিপত্তি হয়েছে যে, আমার কথামতো কতগুলি লোককে কাজ করতে হয়।

বসতে বললে বসতে হয়, দাঁড়াতে বললে দাঁড়াতে হয়, কথা না শুনলে কোমরের বেল্ট খুলে মার দেই। কারও প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নাই। আল্লাহ আমাকে খুব সম্মান দিয়েছে। এত বড় সম্মান সকলের কিসমতে হয় না। গ্রামের লোক আমাকে চোর বললে কি হবে, জেলে আমি একটা মাতুব্বার শ্রেণীর লোক।” ওপরের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু মানবচরিত্রের অলিগলি সম্পর্কে সবিশেষ সজাগ ছিলেন। এটি সম্ভব হয়েছিলো, তিনি মানুষকে তার পোশাকী পরিচয়ের মধ্যে সীমায়িত না রেখে তার মৌলচরিত্র বুঝতে সচেতন ছিলেন। আইয়ুব খান সে জন্যই তাঁর চোখে একজন রাষ্ট্রপতি নয়, বরঞ্চ একজন স্বৈরশাসক হিসেবে ধরা পড়েছিলো।

এই চিন্তার অনুসরণে বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ শক্তির আরেকটা মাত্রার কথা আমরা ধরতে পারি। একটু আগেই সাংবাদিক রল নক্সের প্রতিবেদনের ওপর তাঁর আশাব্যঞ্জক মন্তব্যের কথা বললাম। কিন্তু এই মন্তব্যের পরেই তাঁর আরেকটা পর্যবেক্ষণের কথার উল্লেখ করলে বোঝা যাবে বঙ্গবন্ধুর অর্ন্তদৃষ্টিতে কিছুই অগোচরীভূত ছিল না। এটি হলো, বাঙালি জাতির গোঁ-এর পাশাপাশি আছে মারাত্মক ধংসাত্মক আরেকটি প্রবণতা। সেটিকে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘পরশ্রীকাতরতা’। তাঁকে উদ্ধৃত করি:

. . . জাতি হিসেবে বাঙালি পরশ্রীকাতর জাতি। ’পরশ্রীকাতরতা’ দুনিয়ার কোনো ভাষায় খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। এটি আমাদের চরিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকার যেভাবে বাংলাকে শোষণ করেছিল তার চেয়েও উলঙ্গভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি কলোনিয়াল শোষকরা পূর্ব বাংলাকে শোষণ করছে। ইংরেজদের শাসনের সময়ও ইংরেজকে সাহায্য করবার জন্য বাঙালির অভাব হয় নাই। আজও হবে না।

‘আজও হবে না’, অর্থাৎ পরশ্রীকাতরতা জন্ম দেয় হিংসার যার অবশম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে ষড়যন্ত্রেন মাধ্যমে হত্যা। দুর্ভাবনার ব্যাপার হলো, পরশ্রীকাতরতা সাহিত্য নির্মাণে একটি সবল উপাদান হলেও, বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্রে এটি চরম বিয়োগান্তুক মাত্রা। বঙ্গবন্ধুর তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ শাসন করছেন প্রায় এক যুগ ধরে, এবং বাংলাদেশের ভৌত-কাঠামোর উন্নতি ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিক্ষা ও চিকিৎসার উন্নতিসহ নারীর ক্ষমতায়নেও বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে অসামান্য। আরো শত রকমের উন্নতি হয়েছে, যেগুলির বর্ণনার জায়গা এখানে নয়; কিন্তু যে পরশ্রীকাতরতার শিকার বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন, সে পরশ্রীকাতরতা এখনো সমাজ থেকে তিরোহিত হয়েছে বলা যাবে না। এখানে ভীষণ একটা রাজনৈতিক সচেতনতা জন্মানোর প্রয়োজন, যাতে পরশ্রীকাতরতা উসকে ওঠার বদলে সমাজের চর্তুদিকে একটি ভারসাম্যতা তৈরি হয় শেখ হাসিনার বিদূষী রাজনৈতিক বিচক্ষণতায়। রাজনীতির পথটা অতিমাত্রায় পিচ্ছিল, তাই সকল পরশ্রীকাতরতা অবসান কামনা করি।
বঙ্গবন্ধু অচলায়তনের দুয়ার ভেঙ্গে তাঁর জ্যোর্তিময়ী প্রভায় নিষিক্ত করে সোনার বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন। এই ঐতিহ্য আমরা কখনো হারাতে চাই না।

লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় , ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

 

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.