১৫ আগস্ট ১৯৭৫। লিখবো কি অবুঝ এক সন্তানের বাবা-মাকে কাছে পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষার কথা; তাঁদেরকে খুজে বেড়ানোর কথা! নাকি লিখবো, নীড়বে নিভৃতে ডুকরে ডুকরে কাঁদার কথা! – ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস

0

১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
এ উপলক্ষ্যে আমাকে কিছু লেখার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু কি লিখবো…! লিখবো কি অবুঝ এক সন্তানের বাবা-মাকে কাছে পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষার কথা; তাঁদেরকে খুজে বেড়ানোর কথা! নাকি লিখবো, নীড়বে নিভৃতে ডুকরে ডুকরে কাঁদার কথা! লিখবো কি সব কস্ট সহ্য করার প্রবলশক্তি অর্জনের কথা! নাকি লিখবো তাঁর বুকে প্রতিহিংসার আগুনের কথা! আমি জানিনা, তবু লিখতে বসেছি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
তখনও আমার বয়স চার বছর পূর্ণ হয়নি! সারাদিন মা-এর সাথে লেগে থাকতাম, তাঁর পিছনে পিছনে। একটু চোখের আড়াল হতে দিতাম না। মা বাথরুমে গেলেও বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর দরজা ধাক্কাতাম; কখন মা বেড়িয়ে আসবে। আমার মা সামসুন্নেসা আরজু মনি। স্বামীকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, ঘাতকের নির্মম বুলেট নিয়েছেন নিজের বুকে ও পেটে। পারেননি তবুও স্বামীকে বাঁচাতে। অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থাতেই উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রাণ। রেখে গেছেন দুই অবুঝ সন্তান-পরশ ও তাপস।

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সময়… সেই দুই সন্তানের কথা মনে করে নীরবে ফেলেছেন চোখের পানি। শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের মুহুর্তে পাশে বসা দেবর শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে শুধু বলে গেছেন; সেলিম ভাই, ‘আমার পরশ-তাপসকে দেইখেন’! দেবর শেখ ফজলুল করিম সেলিম
অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তাঁর ভাবীর সেই শেষ অনুরোধ। বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে লালন-পালন করেছেন বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মনির সেই দুই পুত্র সন্তান পরশ ও তাপসকে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। মায়ের দুটি গান খুব প্রিয় ছিল এবং দুটি গানই আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় মা গাইতেনঃ ০১। পরশ/তাপস সোনা বলি শোন থাকবে না আর দুঃখ কোন মানুষ যদি হতে পারো।  ০২। ও তোতা পাখিরে শিকল খুলে উড়িয়ে দিব আমার মাকে যদি এনে দিস সবাই বলে ওই আকাশে….!  আমার বড় চাচী ফাতেমা সেলিম আমাদের এই দুটি গান গেয়ে শুনাতেন এবং ঘুম পাড়াতেন। মা এর সব গল্প বলতেন। দাদা নানী খালা ও ফুফুদের কাছ থেকে মায়ের সব গল্প শুনেছি। শুনেছি গল্প বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থেকে। পিতা-মাতা হাঁরানোর ব্যাথা যারা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুধাবন করে।

মা….! মা এর স্মৃতি বলতে কয়েক সেকেন্ডের কম হবে এমন একটি মুহূর্ত আবছা আবছা মনে পড়ে। আমার মা মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কিছুদিন ‘নানা আবদুর রব সেরনিয়াবাত-এর বাসায় গিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই সময়ের কোন একদিন মা পড়ছিল আর আমি আরিফ মামার সাথে খেলছিলাম। আরিফ মামা আমাকে ধরতে আসছিল আর আমি মা এর কাছে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। এ রকম একটি মুহূর্তে আরিফ মামা আমাকে ধরতে আসলো আর আমি মা-এর কাছে দৌড়ে গেলাম। … … মা পড়ার টেবিলে চেয়ারে মনোযোগ দিয়ে পড়া মুখস্ত করছিল! শুধু মনে পড়ে; ‘আমি দৌড়ে মা’র চেয়ার ধরলাম আর মা হাসি মুখে আমার দিকে তাকালো’…! আজও স্বপ্নের মতো লাগে আমার কাছে সেই মুহূর্তটা!  আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মূহুর্ত্ত।  আমার সবচেয়ে বড় কস্ট-মা এর আর কোন স্মৃতি নেই আমার কাছে।

আমি মনে করতে পারি না… মা এর হাসি ভরা মুখ, তাঁর আদর আলিঙ্গন; তাঁর ভালোবাসা, তাঁর রাগ দুঃখ – কান্না! মনে করতে পারি না- – আমাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়ানো; – আমাকে গোসল করানো; – আমাকে পড়তে বসানো; – আমাকে কোলে নিয়ে চুল আঁচড়ানো! চার বছরের সেই অবুঝ ছেলেটি আজ………..!… … খুঁজে ফিরছি মা এর সৃতি! মা এর হাসি আদর আলিঙ্গন ভালোবাসা। অবুঝ বয়সেই বুঝতে পেরেছি – আর পাবো না! – মা-কেও না…! – তাঁর স্মৃতিও না…! – জেনেছি কঠিন সত্য; জীবনে চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না…! বুকের মধ্যে কস্ট সহ্য করতে শিখেছি! কেঁদেছি নীরবে ডুকরে ডুকরে! জানতে দেইনি কখনোই কাউকে। অনেকে বলে স্মৃতি তুমি বেদনার…! আর আমি বলি, স্মৃতি না থাকার বেদনা যে কত কস্টের… তা কেউ বুঝলো না। আমাকে একটু আমার মায়ের স্মৃতি দাও, আমি তাই নিয়ে বেঁচে থাকি।

লেখক : ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস-মেয়র : ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.