বঙ্গবন্ধু ফিরলেন পূর্ণতা পেল স্বাধীনতা । বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

0

‘এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশার অভিযাত্রা। আমি ৯ মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এই ৯ মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী।’

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ মুক্ত হয়ে এভাবেই মর্মস্পর্শী কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ ২৯০ দিন কারাভোগের পর এদিন পাকিস্তানে কুখ্যাত মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে বন্দী বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন-স্বদেশ, মুক্ত বাংলাদেশে। মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আনন্দাশ্রুতে মথিত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ, বাংলাদেশের আপামর বাঙালী।

স্বাধীনতার ২৪ দিন পর দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। চূড়ান্ত বিজয়ের পর এদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অপেক্ষায় ছিল গোটা বাঙালী জাতি। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ তাঁকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। মূলত এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লেখালেখি চলতে থাকে। তাঁর মুক্তির দাবি জোরালো হয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ২৩ ডিসেম্বর দেশে ফিরলে এই দাবি আরও সোচ্চার হয়। ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করে সাংবাদিকদের কাছে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। ২১ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুকে অজ্ঞাত স্থানে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার জন্য ২৩ তারিখে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর ২৭ ও ২৯ ডিসেম্বর দুটি বৈঠকের কথা জানা যায় সংবাদ মাধ্যমে। আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ পত্রিকাগুলোতে না পাওয়া গেলেও বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতকার, ভুট্টোর জীবনী লেখক স্টেনলি উলপার্ট ও সাংবাদিক রবার্ট পেইনের লেখায় অনেক তথ্য জানা যায়। দুটি বৈঠকেই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে যে কোন মূল্যে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু কৌশলে দেশে ফিরে জনগণের সঙ্গে কথা না বলে কোন প্রুতিশ্রুতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ভুট্টো পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে ‘কনফেডারেশনের’ প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণের প্রস্তাবও দেন। উলপার্ট নিজেও স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে ব্ল্যাকমেল করার কাজে এই বৈঠকের আলোচ্যসূচীকে ব্যবহার করেছেন। ভুট্টোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে ৮ জানুয়ারি আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেখানেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করে পরদিন দেশের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ফেরার পথে ভারতে যাত্রাবিরতি দিয়ে অবশেষে জানুয়ারির ১০ তারিখে দেশে পৌঁছান বাঙালীর মহানায়ক।

॥ দুই ॥

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার একদিন আগে ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ (রবিবার) দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল, ‘সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে লন্ডন হইতে গতকাল সন্ধ্যায় পরিবারবর্গের সহিত টেলিফোনে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমরা সবাই বেঁচে আছ? তাঁর কনিষ্ঠতম পুত্র, সাত বছরের ‘রাসেল’ তার বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘আব্বা, ওরা কি তোমায় ছেড়ে দিয়েছে? তুমি কবে আসবে? ওরা কিন্তু আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে।’ টেলিফোনে কথা বলার সময় এক অবর্ণনীয় আনন্দাতিশয্যে পরিবারের সদস্যদের চোখ হইতে অশ্রুর মালা ঝরিয়া পড়িতেছিল।’

দেশে ফেরার পরদিন পুরো ঘটনাকে ‘এক হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত’ হিসেবে উল্লেখ করে মর্নিং নিউজ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর পরিবারের সদস্যদের ধানম-ি আবাসিক এলাকার ১৮ নম্বর সড়কের যে বাড়িটায় গৃহবন্দী করে রেখেছিল সেখানকার বর্ণনাতেই এভাবে উল্লেখ করে পত্রিকাটি। সময় তখন ৫টা ৩৫ মিনিট। বাড়ির বাইরে তখনও অগণিত মানুষের ভিড়। তারা তাদের নেতাকে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে সম্ভাষণ জানাচ্ছিল। উল্লসিত মানুষের ভিড় বাড়ির সব ক’টি প্রবেশপথ এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলিত হতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে আসতে হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন ভেতরে ঢুকলেন, তখন বড় মেয়ে শেখ হাসিনা তাঁকে বরণ করে নেন। সেটা এমন এক মুহূর্ত ছিল, যা বর্ণনা করার মতো ভাষা নেই। আবেগরুদ্ধ হাসিনার কাছেও কোন ভাষা ছিল না। যে বাবার বুকে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তিনি নিজেই তখন কান্না সামলাতে যুদ্ধরত। সুখে আর নতুন করে পাওয়া এক নিশ্চয়তাবোধে দুজনেই কাঁদতে শুরু করলেন। যদিও হৃদয়স্পর্শী মুহূর্তটি তখনও বাকি। বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর আশি পেরোনো মায়ের সামনে এগিয়ে গেলেন মাকে জড়িয়ে ধরে লৌহমানব হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিব শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। পুরো ঘরের দখল নিয়ে নিল নীরবতা। এই পুনর্মিলন দৃশ্যের সাক্ষীদের অনেকেই কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। যুদ্ধের সময় দেশে না থাকলেও কতটা মনোবল ছিল বঙ্গবন্ধুর তা দেশে ফেরার পর দেয়া বক্তৃতা থেকেও বোঝা যায়। তিনি অকপটে বলেছিলেন, ‘আমি ঠিক করেছিলাম, আমিও তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা।’

॥ তিন ॥

১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার মাসখানেক পরেই (ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করার সুযোগ হয়েছিল আমার। যদিও বঙ্গবন্ধুকে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল। ছয় দফার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারণায় এদিন পাবনা টাউন হলে আয়োজিত একটি জনসভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ আদরের ডাক ‘তুই’ সম্বোধন করে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন আমাকে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম জাতীয় নেতা হিসেবে, ১৯৭২ সালে পেলাম স্বাধীনতার স্থপতি ও বাঙালী জাতির পিতা হিসেবে। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনায় ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বভাবতই জনসভার স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ল। বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভাল বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব, কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির পিতার দিকে। পরে দু-একটি কথা বলে স্টেজের পাশে গেলাম। পরে এই ভেবে আনন্দিত হলাম যে, মাত্র ১৮ মিনিট বক্তৃতায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতায় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন, সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়।

বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি-না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামল পুরনো বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও।’ ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক পূর্বের ন্যায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।

বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই বাঙালীর হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সোনার বাংলা গড়ার কাজে এগিয়ে গেছে জ্যামিতিক হারে। দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণ, বৈষম্যের অবসান হয়ে লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছে বাঙালী। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে ফিরে বাঙালী জাতির উদ্দেশে প্রাথমিকভাবে যে পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার মধ্যে উন্নত জীবন ব্যবস্থা ছিল সর্বাগ্রে। রেসকোর্সে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ না থেকেও যদি সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান শুধু মানবসম্পদ সৃষ্টি করে উন্নত হতে পারে, তবে বাংলাদেশও একদিন সবক্ষেত্রে উন্নত হবে। জাতির জনক মনে করতেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি, সঙ্কীর্ণতা থেকে আলোক পথে যাত্রা। আর এ কারণেই তিনি ‘বৈষম্যহীন উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠায় দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে আজ উন্নতির শিখরে নিয়ে বিশ্বসভায় অনন্য সম্মান অর্জন করেছেন।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য : উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.