মুক্তি । জসিম মল্লিক । টরন্টো

0

মুক্তি
জসিম মল্লিক

আমার প্রায়ই একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। একলা বাঁচতে ইচ্ছা করে। অনেক বছর একলা বাঁচিনা। শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলো খুব ভাল ছিল। তখন আমি একলা বেঁচেছিলাম। তখন মাঝে মাঝে আমার ভিতর থেকে আর একটা আমি বেড়িয়ে আসত। সেই আমিকে কেউ চিনত না। সে একলা কাঁদত , একলা হাসত, একলা বেড়াত, একলা বাঁচত। আমার মাও সেই আমিকে চিনতে পারেনি কখনো। সেই আমিকে আবার আমি ফিরে পেতে চাই। আমার অনেক একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। চারিদিকে এতো মানুষের ভীড়ে, এতো দ্বায়িত্বের বোঝ বয়ে আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। একত্রিশ বছর ধরে প্রেমে, স্নেহে, আহ্লাদে, আশ্লেষে, মমতায়, শাসনে, ভাষনে, কন্ট্রোলে, যুদ্ধে, শান্তিতে, জয়ে-পরাজয়ে, আপোষে, স্ট্রেসে, আশায়, নিরাশায়, ভালবাসায়, ঘৃণায়, অসুস্থ্যতায়, সুখে দুঃখে বেঁচে আছি। যার নাম সংসার!
এইভাবে বাঁচার মধ্যে একঘেয়েমি আছে। এসব একঘেয়েমি থেকে পরিত্রাণ দরকার। একলা বাঁচা দরকার। সবারই একলা বাঁচার দরকার আছে। নিজের মতো করে বাঁচার দরকার আছে। নিজেকে চেনার দরকার আছে। নিজের মুখোমুখি হওয়ার দরকার আছে। কারো আজ্ঞাবহ হয়ে নয়, কারো অধীনে নয়, হিংসায় নয়, ঈর্ষায় নয়, ঘৃণায় নয়, অবহেলা আর অবজ্ঞায় নয়, প্রতিযোগতিায় নয়, প্রতিহিংসায় নয় শুধু নিজের মতো একলা বাঁচা, মৌনতায় বাঁচা, নিরবতায় অবগাহন করে বাঁচা। যখনই অনেক বেশি চাওয়া থাকবে, প্রত্যাশা থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, দেখানেপনা থাকবে তখনই জীবন হয়ে উঠবে যন্ত্রণার। কারো না কারো অধীনস্ত হতে হবে, কেউ না কেউ আপনাকে কন্ট্রোল করতে চাইবে, আপনি অন্যের অধীন হয়ে যাবেন। আপনার স্বাধীনতা, আপনার স্বাতন্ত্র ধুলোয় লুটোপুটি খাবে। অন্ততঃ একবার হলেও চেষ্টা করুন নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদ করে ফেলতে। নিজের অস্তিত্বকে স্বাতন্ত্র দিতে। নিজেকে বুঝতে।

জেনে রাখুন দিন শেষে আপনি একলা। খুউব একলা। আপনার কেউ নেই। এই যে চারিদিকে এতো কিছু দেখি, আপনজনের মতো মনে হয়, তারা কেউ আপন নয়, তারা প্রত্যেকে যার যার। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা ভাই-বোন বন্ধু-পরিজন, এঁদের সাথে মায়ায়, স্নেহে, ভালবাসায় জড়িয়ে থাকি ঠিকই কিন্তু এরা কেউই আপনার নয়। আপনি একা। আপানার কেউ নাই। সংসার একটা শৃঙ্খল। আপনি সত্যি গভীরভাবে একবার ভাবুন, গভীর রাতে ভাবুন, নির্জনে ভাবুন, নিরবতায় ভাবুন। আপনি একজন একক মানুষ, একক সত্ত্বা। আপনি একজন অনন্য মানুষ। অনেকের মধ্যে থেকেও আপনি একলা। তাই প্রতিটি মানুষের একবার হলেও একাকী বাঁচার দরকার আছে। আপনি যদি একা না হতে পারেন তাহলে আপনার আত্মার অবমাননা হবে। নিজেকে নিজে আপনি অপমানিত করবেন। জেনে রাখুন পৃথিবীতে কেউ কারো নয়।
আমি একলা বাঁচার কথা ভাবি। নিজের মধ্যে নিজের ডুব দিয়ে থাকা। আমি কথা বলি আমার নিজের সাথে। নিজের সাথে আমি ভাল বোঝাপড়া তৈরি করেছি। নিজের সাথে নিজে অনর্গল কথা বলতে পারি আমি। আমিই আমার শ্রোতা। নিজেই নিজের কথায় হাসি, নিজেই নিজের কথায় কাঁদি। এভাবেই আমি বেঁচে থাকি। কোলাহলপূর্ণ মানুষদের কাছ থেকে দুরে। নির্জনে বেঁচে থাকি। আগের দিনে যেমন মানুষ নির্জণতার সন্ধানে গুহায় চলে যেতো। গৌতম বুদ্ধু গৃহত্যাগী হয়েছিলেন। মানুষের বার্ধক্য ও জ্বরা, মৃত্যু দর্শনে তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহনের উদ্দেশ্য কী? আমাদের জন্ম কি বার্ধক্য পাবার জন্যে, অসুস্থতা ভোগ করে মৃত্যুতে গত হবার জন্যে? সংসারের ঘানি টানার জন্যে? পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য কী?

এই যে আমাদের বস্তুময় পৃথিবী, এই যে বাস্তবতা, ফলিত ব্যক্ত জগৎ, এই যে আকাশ, মাটি, আলো, অন্ধকার, এসব ততক্ষনই সত্য যতক্ষন আমাদের ইন্দ্রিয়াদি তাদের অনুভব করছে। আর এই ইন্দ্রিয়াদি ততক্ষণই কার্যক্ষম যতক্ষণ আমাদের অস্তিত্বে অবস্থান করছে ওই প্রাণ নামক রহস্যময় একটি জিনিস! ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না, তবু আছে।
ছাদের কার্নিশের দুটো দিকই বিপজ্জনক নয়। জীবন ওরকমই, বিপদ-আপদ থাকে, নিঃসঙ্গতা থাকে, নির্জণতা থাকে আবার নিরাপত্তাও থাকে। আমার কাছে ফ্রিডম মানে স্বাধীনতা নয়, ফ্রিডম মানে মুক্তি। ভয়ের হাত থেকে মুক্তি, জরাগ্রস্ততার হাত থেকে মুক্তি, অন্যের অনুগ্রহ হয়ে বাঁচার হাত থেকে মুক্তি, সংসারের ক্লান্তিকর একঘেয়েমি থেকে মুক্তি এবং সবশেষে জীবন থেকে মুক্তি। কিন্তু জানা নেই সেই মুক্তি কোথায় আছে!
টরন্টো ৯ অক্টোবর ২০২০

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.