একদিন আমরা মানুষ ছিলাম । জসিম মল্লিক। টরন্টো

0

একদিন আমরা মানুষ ছিলাম
জসিম মল্লিক

মানুষ বেঁচে থাকতে একবারও ভাবে না জীবন কত ক্ষনস্থায়ী। যদি ভাবত যে ভাল কাজগুলিই শুধু থাকবে, ভাল একটা কথা, মিষ্টি একটা হাসি, কারো একটু উপকার করা, বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, দুঃখের দিনে পাশে থাকা, একটু স্নেহের পরশ বুলানো, মাথায় একটু ভরসার হাত রাখা, ভালবাসা দেওয়া এসবের মূল্য অসীম। এসবই স্মৃতিতে জাগরুক থাকবে। মৃত্যুর পর বলবে মানুষটা বড় ভাল ছিল। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। ভাল শাসকদের কথা মানুষ শত শত বছর মনে রাখে। আর খারাপ বা অত্যাচারি শাসকদের চিরদিন ঘৃণার সাথে স্মরণ করে। আমি দারুণ স্নেহ ভালবাসার কাঙাল। বিড়ালের মতো গদ গদ হয়ে যাই কেউ একটু মিষ্টি কথা বললে, ভালবাসার কথা বললে। কেউ ভালবাসার অভিনয় করলেও আমি বিগলিত হয়ে পড়ি। সত্যি মনে হয়। ঠকেও জিতে যাই। পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই ভাল। বেশিরভাগ মানুষই ভালবাসতে জানে। আমার মতোই।
আমি কারো কাছে কোনোদিন কোনো অনুগ্রহ চাইনি, হাত পাতিনি, মাথাও নত করিনি। আমি শুধু চেয়েছি কেউ যেনো আমাকে অবহেলার চোখে না দেখে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করে, আমার সাথে ছল চাতুরি না করে। আমি এসব একদম নিতে পারি না। কিন্তু তা সত্বেও আমি জীবনে অনেকই অবহেলার শিকার হয়েছি। আমার প্রাপ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমাকে অপমানিত হতে হয়েছে। এইসব কষ্ট কখনো ভোলা যায় না। আমাকে ঠকিয়েছে অনেকেই। অনেককে বিশ্বাস করেও ঠকেছি। কিন্তু তারপরও মানুষের প্রতি আমার ভালবাসার বা বিশ্বাসের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ওসব থেকে আমি শিখেছি বটে কিন্তু আমি নিজেকে বদলাইনি। এর কারণ হচ্ছে আমি মানুষের কাছ থেকে যতনা অবহেলা আর তাচ্ছিল্য পেয়েছি ভালবাসা পেয়েছি তারচেয়ে বহুগুন।

জীবনে চলার পথে অনেকের সাথেই আমাদের সখ্যতা হয়, ঘনিষ্ঠতা হয়, ভালবাসা হয়, প্রেম হয়। আবার একদিন সেসব হারিয়েও যায়। সে এক রহস্য বটে। জীবন খুবই রহসম্যয়। মানুষ একসাথে অনেক কিছু ধারন করতে পারে না সম্ভবত। আমার শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যের অনেক বন্ধুকে, অনেক চেনা মানুষকে হারিয়ে ফেলেছি আমি, অনেক আত্মীয়দের সাথে দুরত্ব তৈরী হয়েছে। অনেকে আমাকে যেমন খারিজ করে দিয়েছে তেমনি আমিও অনেক সম্পর্ককে ধরে রাখতে পারিনি। আমার অনেক ব্যর্থতা। জীবন সংগ্রামে এতোটাই বিভোর ছিলাম যে অনেক সম্পর্ক স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। আসলে কি সব হারিয়ে যায় জীবন থেকে! যায় না।
সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে পুরনো অনেকের সাথে আবার যোগাযোগ ঘটে যায়। পুরনো বন্ধুরা স্মৃতি হাতরিয়ে অনেক মুক্তো মানিক তুলে আনে। পুরনো অনেক কিছু ভুলে গেছি দেখে নিজেই লজ্জিত হই। নিজেকে বলি ছিঃ আমি এমন! কেমন করে এসব ভুলে থাকলাম! যাদের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলাম এক সময় তাদের সাথেও দূরত্ব তৈরী হয়েছে। ভালবাসা করেছিলাম যাদের সাথে তাদের সাথেও বিচ্ছিন্নতা এসেছে। এসব ভাবলে আজকাল খুব কষ্ট লাগে। আর হয়ত সেসব সম্পর্ক জোড়া লাগবে না। আবার আগের জায়গায় ফিরবে না কিছুই। এই অপূর্ণতা নিয়েই একদিন বিদায় হব। জীবন কত ক্ষনস্থয়ী তা কোভিডকালে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কত আপনজন হারিয়েছি আমরা। কারো জন্য শোক প্রকাশের সময়ও পাই না। নিরিবিলি দুফোটা চোখের জল ফেলার ফুরসত পাওয়া যায় না।

প্রকৃতির এই বিপর্যয় থেকে আমরা শিখি না। এখনও পৃথিবীতে কত অনিয়ম, অবিচার, নিষ্ঠুরতা, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, ঈর্ষা, ঘৃণার বিষবাষ্প ছাড়ানো। একে অন্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা। মনে হয় পৃথিবী থেকে এসবের মুক্তি নাই। অনেক ক্ষুদ্র সব ব্যাপারে আমরা নিচুতার পরিচয় দেই। ঈর্ষাকাতর হই। অনেক সময় অবচেতন মনেও হই। আচ্ছা ঈর্ষা জিনিষটা কে আবিষ্কার করেছে! কোথায় থাকে! জেলাসি ইজ অল বলস। আমার নিজের মধ্যেও জেলাসি আছে। অবচেতনেই জেলাসি কাজ করে।
সে এক রহস্য বটে। এখানেই মানুষের সীমাবদ্ধতা, ক্ষুদ্রতা। এসবের উর্ধ্বে একদম উঠতে পারি না আমরা। ফেসবুকের কথাই ধরা যাক। অনেক হাই প্রোফাইল বন্ধু আছে আমার যাদের সব কিছুতে আমি প্রতিক্রিয়া দেখাই, অনেক তুচ্ছ জিনিস, পাতে নেওয়ার মতো না তাতেও লাইক দেই কিন্তু তারা অনেকেই আমার ব্যাপারে নির্বিকার থাকে। এটাই মনে হয় মানুষের জীবনের ধর্ম। এতে বিষ্মিত হওয়ার কিছু নাই।
কিন্তু আমি আমার সব বন্ধুর প্রতি সমান প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করি। বিশেষ কারো প্রতি পক্ষপাত দেখাই না কারণ আমার কোনো গ্রুপ নাই, বিশেষ কারো নজরে আসার সবিশেষ আগ্রহ নাই। কারো কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নাই। মিলিওনিয়ার বন্ধু যেমন আছে আমার তেমনি দোকানদার বন্ধুও আছে। লেখক বন্ধু যেমন আছে, উকিলও আছে। পুলিশের বড় কর্তা যেমন আছে সিকিউরিটি গার্ড আছে, ডেলিভারি ম্যান আছে, ট্যাক্সি চালকও আছে। এমপি, মন্ত্রী যেমন আছে মেম্বার সাবও আছে। কে নাই! সব টাইপই আছে। রুপবতী যেমন আছে তেমনি কুৎসিত দেখতেও আছে, তরুণ যেমন আছে বৃদ্ধও আছে। দশ বিশ হাজার লাইক আর লক্ষ ফলোয়ারের অধিকারী বন্ধু যেমন আছে, দশ বিশটা লাইক কমেন্টস পাওয়া বন্ধুও কাছে। অল আর সেম।
টরন্টো ১১ মে ২০২১

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.